সবার আগে ইল্ম
খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী, যখন রাব্বুল আলামীনের প্রিয়তম হাবীব, বিশ্বজগতের করুণা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন ছিল পৃথিবীর সে সময়টা বা সে সময়ের পৃথিবী? কাগজ-কলম হাতে নিন; মানুষের দ্বারা সংঘঠিত হওয়া সম্ভব এমন সব পাপ-অপরাধ, অন্যায়-অনাচার, ব্যভিচার ও বিপর্যয়ের তালিকা প্রস্তুত করুন- পঞ্চাশ বা একশত, পাঁচশত বা পাঁচহাজার বা আরো বেশি- তালিকাটা পাশে রাখুন। এবার সে সময়ের ইতিহাসের পাতা উল্টান, চোখ রাখুন সমগ্র পৃথিবীর মানচিত্রে- এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা- প্রতিটি জনপদের মানুষের কর্মকাণ্ডের সাথে মিলান আপনার প্রস্তুতকৃত অপরাধতালিকা। কী দেখতে পাচ্ছেন? না, কোনো জনপদই মুক্ত নয় কোনো একটি অপরাধ থেকে? ইসলামপূর্ব এই বিপর্যস্ত সময়, এই পাপপঙ্কিল পৃথিবীকে কী নামে চিত্রিত করেছে ইসলাম? ব্যভিচারের যুগ? খুন-খারাবির যুগ? সুদ-ঘুষের যুগ? যুলুম-নির্যাতনের যুগ? অবিচার-অনাচারের যুগ? না, বরং ইসলাম সে সময়ের নাম দিয়েছে আইয়ামে জাহিলিয়্যাত- অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা বা জ্ঞান- ও শিক্ষাহীনতা বা মূর্খতার যুগ। আর এই সর্বরোগক্লিষ্ট মুমূর্ষু মানবতার চিকিৎসায় দয়াময় প্রতিপালক বিশ্বজগতের করুণা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম যে আসমানি প্রেসক্রিপশন পাঠালেন তা হল ‘পড়ো’। একটি আয়াত পরে তৃতীয় বাক্যে আবারো পুনরুক্ত করলেন, ‘পড়ো’। আর এই প্রাথমিক ওহির পাঁচটিমাত্র আয়াতে লেখা পড়ার অনিবার্য উপকরণ ‘কলম’কেও উপস্থিত করলেন। আসুন আমরা প্রথম ওহির সে পাঁচটি আয়াতে একবার চোখ বুলিয়ে নিই। পড়ো তোমার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। পড়ো, তোমার পালনকর্তা মহামহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না (আলকুরআন ৯৬/১-৫)। অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে মানবতার সকল বিপর্যয়ের মূল অজ্ঞতা বা পাঠবিমুখতা আর তার চিকিৎসা ও সুস্থ থাকবার জন্য অনিবার্য শর্ত হচ্ছে পড়া বা জ্ঞান অর্জন; শিক্ষা বা জ্ঞানবিমুখ জাতির নিয়তিই হচ্ছে স্থায়ী অসুস্থতা!
মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানোর প্রাক্কালে দয়ালু মাবুদ বলে দিয়েছিলেন, … এবার তোমরা এখান থেকে নেমে যাও, আর আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে পথনির্দেশ পৌঁছবে, যারা সে পথনির্দেশনার অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না (আলকুরআন ২/৩৮)। সে মোতাবেক মহান আল্লাহ আপন দূত-রাসুলগণ মারফত প্রত্যেক দেশ, কাল ও জাতির জন্যই তাদের উপযুক্ত দয়া-নির্দেশনা পাঠিয়েছেন এবং প্রয়োজন শেষে তাঁর আপন ইচ্ছাতেই সেসব কিতাব-নির্দেশ বিকৃত বিস্মৃত ও অপহত হয়ে যায়। অবশেষে সব দেশ কাল ও জাতির জন্য চূড়ান্ত ও সর্বজনীন যে পথনির্দেশ তিনি পাঠান এবং যার স্থায়ীরূপে সংরক্ষণের দায়িত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করেন, সে পরম ও চূড়ান্ত বাণী-নির্দেশকে, পৃথিবীর যে কালিক পরিস্থিতিতে ‘ইকরা’ বা ‘পড়ো’ নির্দেশ দিয়ে শুরু করেন- সর্বজ্ঞ প্রতিপালকের এ অবতারণ-দস্তুর থেকেই, কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই, পড়াশোনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়।
এ বর্ণনা-বিন্যাসের সূত্র ধরে আসুন আমরা আমাদের সৃষ্টির সূচনাকালের ইতিহাস স্মরণ করি, যখন আমাদের প্রতিপালক তাঁর ফেরেশতামণ্ডলীকে বলেছিলেন যে, তিনি আমাদের আদি পিতা আদম ও তাঁর বংশধরকে কালক্রমে জমিনে প্রতিনিধি করবেন। এ নতুন সৃষ্টি মানুষকে দিয়ে তিনি পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব করাবেন- এ অভিপ্রায়ের কথা শুনে ফেরেশতাগণ মানুষের দুটি দুর্বলতা- ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা এবং রক্তপাত ঘটানোর কথা আর নিজেদের তাসবীহ, তাহমীদ ও তাকদীস গুণের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেছিলেন, আমি এমন সব বিষয় জানি, যা তোমরা জান না। তারপর তিনি আদমকে শিখিয়েছিলেন সকল বস্তুর নাম, তার গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি। আর এ শিক্ষা ও জ্ঞানের পরীক্ষায়ই তিনি আদমকে দান করলেন তাঁদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব এবং করলেন তাঁদের সিজদার অধিকারী। আর এ মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে ফেরেশতাদের ঊনমত ও তাঁদের নিজেদের গুণপনার বিষয়গুলো মহান আল্লাহ আমলেই আনলেন না। পবিত্রআত্মা ফেরেশতাগণও এ জ্ঞানভিত্তিক মর্যাদাকে মেনে নিলেন এবং সকলেই লুটিয়ে পড়লেন সিজদায়। বেঁকে বসল কেবলমাত্র দুষ্টআত্মা ইবলিস। সে আদমের জ্ঞানগত মর্যাদা মেনে নিল না। তার কাছে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি সৃষ্টির উপাদানগত বৈশিষ্ঠ্য। সে আগুনের তৈরি আর আদম মাটির তৈরি- সুতরাং সে-ই বড়। এ খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে সে অহঙ্কার করল। এভাবেই সে হয়ে গেল চিরঅভিশপ্ত ও বিতাড়িত। অর্থাৎ মানবজাতির সৃষ্টিগত দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা, তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড ইলম বা জ্ঞান, অন্য কিছ ুনয়, আর স্বাধীন জ্ঞানের অধিকারীর কিছু বিচ্যুতি অস্বাভাবিক নয় এবং একটা সীমার ভেতর পর্যন্ত তা স্বীকৃত ও ক্ষমার্হ। এবং জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করাই ফেরেশতাদের গুণ আর তা অস্বীকার করা ও অন্য কিছুকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বানানো অভিশপ্ত শয়তানের স্বভাব। এ-ই তো মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, ফেরেশতাদের পবিত্রতা ও ইবলিসের অভিশাপের ইতিহাস। ওহি নাযিলের সূচনাতেই মহান আল্লাহ ‘পড়ো, তোমার প্রতিপালকের নামে’ আদেশের প্রক্রিয়ায় আমাদের সেই যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমকেই স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমরা যেনো ভুল কিছুকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি ধরে তাতেই আত্মনিয়োগ করে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধনের যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ না হই।
এখানে আমরা বাইবেল পড়ুয়া কিছু জ্ঞানপাপীর একটি ভ্রান্তি অপনোদনের চেষ্টা করি। তারা বলে থাকেন, স্রষ্টা মানুষের স্বাধীন বিচার-বিবেচনা ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে পছন্দ করেন না; তিনি চান, ভক্তি গদগদ আনুগত্য-উপাসনা। যে কারণে মানুষ যখন ইবলিসের সহায়তায় ‘সদাসদ’ জ্ঞান বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে এবং তাতে তাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়, তিনি রুষ্ট হন। ফলে মানুষকে করেন স্বর্গচ্যুত আর ইবলিসকে করেন অভিশপ্ত। কিন্তু আমাদের উপস্থাপিত আলকুরআনের অবিকৃত তথ্য ও ভাষ্য তাদের ধারণাকে ভুল সাব্যস্ত করে এবং সম্পূর্ণ বিপরীত জ্ঞান দান করে।
মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাদের প্রিয়তম নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামও জ্ঞান অর্জনকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য। আল্লাহ মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই। তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দেওয়ার পর সর্বোত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে সালাত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জ্ঞানের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা, তার উপর আমল করা হোক বা না হোক, হাজার রাকআত সালাত আদায় করা থেকে উত্তম (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-২১৯)। তিনি শিক্ষিত বিদ্বান আলিমের শ্রেষ্ঠত্বের তুলনা করে বলেন, একজন সাধারণ ইবাদত গুজার ব্যক্তির উপর একজন বিদ্বান আলিমের মর্যাদা তেমন, যেমন তোমাদের (সাহাবিদের) সর্বনিম্ন ব্যক্তির উপর আমার মর্যাদা। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সাধারণ ইবাদত গুজার ব্যক্তির উপর আলিমের মর্যাদা তেমন, যেমন অন্যসব তারকার উপর পূর্ণিমার রাতের পূর্ণ চাঁদের মর্যাদা (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-৩৬৪১; সুনান তিরমিযি, হাদীস-২৬৮৫; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-২২৩)। একদিন তিনি নিজের হুজরা থেকে বের হয়ে মসজিদে এলেন। সেখানে দুটি হালকা ছিল- এক হালকায় কুরআন তিলাওয়াত ও দুআ হচ্ছিল, অপর হালকায় শিক্ষা ও শেখানো চলছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, উভয় হালকা নেক আমলে আছে; এরা তিলাওয়াত ও দুআয় রত আছে। আল্লাহর ইচ্ছা, তিনি তাদের প্রার্থিত বিষয় দিবেন অথবা দিবেন না। আর এরা পঠন-পাঠনে লিপ্ত আছে। (আমি এদের অন্তর্ভুক্ত) আমাকে শিক্ষক
হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে। তারপর তিনি এই হালকায় বসলেন (সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-২২৯)।
যে কারিগর কোনো কিছু তৈরি করেন তিনি ওই বস্তুর স্বত্বাধিকারী বলে গণ্য হন এবং তার ইচ্ছার ভেতরেই তা ব্যবহৃত হয়। সুতরাং আমাদেরকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন যে সার্বভৌম মালিক, যিনি দ্বিতীয় বার আবারও আমাদের জান-মালকে ক্রয় করেছেন, যিনি ঘোষণা করেছেন, আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে (আলকুরআন ৯/১১১), তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করার বাইরে আমাদের আর কোনো অধিকার কী করে থাকতে পারে? তাই তো তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, মুমিন কোনো নরনারীর এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যখন কোনো বিধান বিধিবদ্ধ করে দেন, তখন সে তার অন্যথা করে; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্য হল সে প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে নিপতিত হল (আলকুরআন ৩৩/৩৬)। সুতরাং আমাদের সৃষ্টিতে মহান আল্লাহর যে অভিপ্রায়- তাঁর ইবাদত ও যমিনের খেলাফত, এর বাইরে যাবার এখতিয়ার বা কোনো গত্যন্তর আমাদের আর নেই। তাই তো আমাদের সকল চেষ্টা-সাধনা হবে এ ক্ষেত্রে পূর্ণ সফলতা লাভের জন্য। আর আমরা এটাও জেনেছি যে, এখানে সফলতা লাভের প্রাথমিক যোগ্যতা হচ্ছে ইলম বা জ্ঞান। হযরত আলী রা. বলেন, ইলম বা জ্ঞানহীন ইবাদতে কোনো কল্যাণ নেই (সুনান দারেমি, হাদীস-৩০৫)।
ইমদাদুল হক
দারুস সুন্নাহ
আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা