২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মুসলিম জীবনে আরবিভাষার গুরুত্ব

প্রতিনিধি :
ইমদাদুল হক
আপডেট :
ডিসেম্বর ১৮, ২০২১
44
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

ইমদাদুল হক

আরবিভাষার ইতিহাস:
আরবিভাষা সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। কোনো কোনো গবেষকের মতে আরবিভাষাই পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ভাষা এবং আরবির বিবর্তনের মাধ্যমেই অন্যান্য ভাষার জন্ম। বর্তমান বিশ্বের ৪৫ কোটি মানুষের প্রধান ভাষা আরবি। এছাড়া এটি ২৯ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা; সে হিসাবে আরবি বিশ্বের চতুর্থ ভাষা। আরববিশ্বের ২২টি দেশ ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশ আরবিকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ব্যবহার করে। জাতিসংঘ, ওআইসি, আফ্রিকান ইউনিয়নসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থারও দাপ্তরিক ভাষা আরবি। এছাড়া পৃথিবীর প্রায় দুইশ কোটি মুসলিম জনসাধারণ প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে আরবিভাষা ব্যবহার করে থাকে।
পৃথিবীতে ইসলাম আগমনের পূর্বেও আরবিভাষা যথেষ্ঠ সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও ভাব প্রকাশে সক্ষম ছিল। ইসলামপূর্ব আরবি সাহিত্য, বিশেষ করে আরবি কবিতামালা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল। একভাষার বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ভাষার জন্ম হয়। কালক্রমে ওই ‘মাতৃভাষা’ সম্পূর্ণরূপে হারিয়েও যায়। কিন্তু আরবিভাষা এক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম। কুরআন ও হাদীস এ ভাষাকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে এবং কুরআন যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত প্রভাবক গ্রন্থ হিসাবে টিকে থাকবে তাই আরবিভাষাও সে পর্যন্ত টিকে থাকবে। তাছাড়া এভাষার ব্যাকরণও খুবই উন্নত; ভাষার খুঁটিনাটি সবকিছুই তা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এভাষায় তাই ব্যাকরণ বহির্ভূত কোনো ব্যবহার নেই।

আন্তর্জাতিক আরবিভাষা দিবস:
জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো অন্য দাপ্তরিক ভাষাগুলোর মতো আরবিভাষা উদ্যাপনের জন্য একটি দিন নির্ধারণ করেছে। দিনটি বিশ্বময় ‘আন্তর্জাতিক আরবিভাষা দিবস’ নামে পরিচিত। সেটি ১৮ ডিসেম্বর।
ইউনেসকো তার প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই আরবিভাষার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। ১৯৪৮ সালে গঠিত হওয়া ইউনেসকো তার তৃতীয় সম্মেলনে ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি আরবিভাষাকেও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৬৮ সাল থেকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক নানান কাজে ভাষাটি ব্যবহৃত হতে শুরু করে। তবে শেষ পর্যন্ত আরব রাষ্ট্রগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭৩ সালে আরবিভাষা চূড়ান্তরূপে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। যেদিন আরবিতার প্রায় চারদশক পর ইউনেসকো ২০১২ সালে এই ১৮ ডিসেম্বরকে ‘আরবিভাষা দিবস’ হিসাবে নির্ধারণ করে এবং পরের বছর ২০১৩ সালে ইউনেসকোর উপদেষ্টা পরিষদ আরব সংস্কৃতি তুলে ধরার লক্ষে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ভাষা এই মর্যাদা লাভ করে সেদিনটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর।
এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হল আরবিভাষা ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা, আরবিভাষাকে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমরূপে গড়ে তোলা। প্রতি বছরই দিনটি উদ্যাপন করতে জাতিসংঘসহ আরব রাষ্ট্রগুলো নানা অনুষ্ঠান ও বহুমুখী কার্যক্রম হাতে নেয়। এ উপলক্ষে হাজার হাজার বছর ধরে আরবিভাষায় চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্বসভ্যতায় এই ভাষার অবদান, আরবিভাষায় জ্ঞান চর্চাকারী বরেণ্য মনীষীদের জীবন ও কর্ম এবং আরবিভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়।

মুসলিম জীবনে আরবিভাষার গুরুত:
মুসলিম জীবনে আরবিভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের উৎসগ্রন্থ কুরআন-হাদীসের ভাষা আরবি। সেখান থেকে জীবন পরিচালনার প্রয়োজনীয় বিধিবিধান আহরণ করতে গেলে আরবিভাষার চাবি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য প্রয়োজনীয় দীনি জ্ঞান অর্জন করা ফরয। এ জ্ঞান তিনি আলিম-উলামার সান্নিধ্য থেকে বা অনুবাদ গ্রন্থ থেকে অর্জন করলেও এর মাধ্যম হিসাবে কিছু আরবি পরিভাষা হলেও তাকে শিখতে হবে। তাছাড়া প্রত্যেক মুসলিম জনপদে অন্তত একজন হলেও শরীআহ-জ্ঞানে গভীর পণ্ডিত আলিমের উপস্থিতি ফরয। যিনি মুসলিম জনসাধারণের সকল দীনি সমস্যার সমাধান দেওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কোনো জনপদ এমন আলিম-শূন্য হলে সেই জনপদের সকলেই ফরয পরিত্যাগের পাপে পাপী হবেন। এ ধরনের প্রাজ্ঞ আলিম হওয়ার জন্য আরবিভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করা অপরিহার্য শর্ত।
আরবিভাষা মুসলিম জীবনের নিত্য-নৈমিত্তিক অনুষঙ্গ। মুসলিম জনপদের মসজিদ থেকে প্রতিদিন পাঁচবার উচ্চস্বরে ঘোষিত হচ্ছে আরবিভাষার আযান। নামায পুরোটাই আরবিতে আদায় করতে হয়। এছাড়াও রয়েছে কুরআন তিলাওয়াত। প্রত্যেক মুসলিমকে অন্তত নামায আদায়ের জন্য আল কুরআন থেকে প্রয়োজন পরিমাণ আরবি কিরাআত শিখতেই হয়। আর নফল ইবাদত হিসাবেও কুরআন তিলাওয়াতের রয়েছে অপরিসীম ফযীলত। হাদীস শরীফে এসেছে, কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি হরফে রয়েছে দশটি নেকি। তবে এ নেকি অনূদিত কুরআন পাঠ করলে পাওয়া যায় না, যদিও তাতে ইলম অন্বেষণের সাওয়াব পাওয়া যায়, কেননা কুরআন মূলত আরবিভাষার গ্রন্থ। মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আমি আরবি কুরআন নাযিল করেছি, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার (সূরা ইউসুফ, আয়াত ২)।
এছাড়া আরব-অনারব সকল মুসলিম জনপদের জুমুআ, দুই ঈদ, বিবাহ ইত্যাদির খুতবাও হয়ে থাকে আরবিতে।
এসব নানাবিধ কারণে আরবিভাষা মূলত দীনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। উমার (রা.) বলেছেন, তোমরা আরবিভাষা শিক্ষা করো, কেননা তা তোমাদের দীনের অংশ। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রাহ.) বলেন, আল্লাহ তাআলা আরবিভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। আর প্রিয় নবী (সা.)-ও আরবিভাষাতেই কুরআন-সুন্নাহ প্রচার করেছেন। দীনের প্রথম অনুসারীগণ ছিলেন আরবিভাষী। দীনের গভীর জ্ঞানার্জনের জন্য এই ভাষা আয়ত্ত করার কোনো বিকল্প নেই। অতএব আরবিভাষা চর্চা করা দীনেরই অংশ এবং দীনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক।
অতএব আরবিভাষা চর্চা দীন চর্চারই অংশ। এছাড়া আরবিভাষা চর্চার অর্থনৈতিক উপযোগিতাও কম নয়।

বাংলাভাষার সমৃদ্ধিতে আরবির অবদান:
ইসলামের অনেক আগেই আরব বণিকদের মাধ্যমে আমাদের এ ভূখণ্ডে আরবিভাষার আগমন ঘটে। ইসলাম আবর ভূখণ্ডে আগমনের অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের ভূখণ্ডে পৌঁছে যায় এবং তখন ইসলামের সাথেসাথে আরবিভাষাও বিপুল প্রভাব নিয়ে এ জনপদের মানুষের মাঝে হাজির হয়। মুসলিম জনসাধারণ তাদের ঈমান ও ইসলামের প্রয়োজনেই খানিকটা আবরিভাষা শিখতে বাধ্য হয়। যখন এ জনপদের মানুষের মাঝে ইসলাম গ্রহণের ধারা শুরু হয়েছে এবং ইসলামের সাথেসাথে নিজেদের ধর্মীয় ভাষা হিসাবে ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে আরবিভাষার সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক স্থাপন করছে, ইতিহাস পর্যালোচনায় অনুমিত, সেটাই বাংলাভাষার জন্ম ও শৈশবকাল। তাই বাংলাভাষা নিজের সমৃদ্ধির জন্য সেই শৈশব থেকেই আরবির কাছ থেকে ভাব ও শব্দ গ্রহণ করেছে দুইহাতে।
আরব বণিক ও ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে এ ভূখণ্ডে আরবিভাষার আগমন ঘটে। অতপর ত্রয়োদশ শতকের প্রথমদিকে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির গৌড় বিজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। এরপর স্বাধীন সুলতান আমলে বাংলায় মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর দীর্ঘকাল এ ভূখণ্ডে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে। মুসলিম জীবনে আরবিভাষার আবেদন ও প্রয়োজনীয়তা আমরা আগেই দেখেছি। সুতরাং কোনো ভূখণ্ডে মুসলিমের উপস্থিতি মানেই আরবিভাষার সরব বিচরণ। এ কারণে নিত্য দিনের কথ্য ভাষাই তো বটেই, এ অঞ্চলের সাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনায়ও আরবিভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখ মুসলিম কবিই কেবল নয়, মুকুন্দ চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখ হিন্দু কবিও আরবি-ফারসি উপাদান ব্যবহার করে সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হন। এমনকি শ্রী রায়গুণাকর আরবি-ফারসির ব্যবহার ছাড়া রচনা প্রসাদ গুণসম্পন্ন ও রসোত্তীর্ণ হয় না বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল/ অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের ধারা অব্যাহত থাকে। এক্ষেত্রে বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদ।
এভাবে বাংলাভাষা কেবল আরবিভাষা থেকে শব্দ ও ভাব গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়েছে তাই নয়, বরং বাংলা ব্যাকরণেও অনেক ক্ষেত্রে আরবির প্রভাব লক্ষ করা যায়। এছাড়া বাংলা ব্যাকরণে এখনো কিছুটা অযৌক্তিকতা ও অপূর্ণতা যে রয়েছে তা পূরণের ক্ষেত্রে বাংলার পণ্ডিতেরা আরবির সাহায্য নিলে বাংলাভাষা ও ভাষাভাষী যথেষ্ট উপকৃত হবে আশা করা যায়।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram