২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের ফযীলত ও আমল

প্রতিনিধি :
সাম্প্রতিকী ডেক্স
আপডেট :
জুলাই ১৯, ২০২০
34
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

মহান আল্লাহ সূরা ফাজরের শুরুতে বলেছেন, “প্রভাতের কসম; কসম দশরাত্রির।” (আয়াত: ১-২)। মুফাসসিরগণ বলেছেন, এখানে ‘দশরাত’ বলতে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে।

আমরা কথা বলার সময় কসম করি বক্তব্যের দৃঢ়তা ও সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু মহান আল্লাহর তা প্রয়োজন নেই। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর কথা চিরসত্য। তাঁর কসমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যার নামে তিনি কসম করেন তার মাহাত্ম্য বোঝানো। সুতরাং এই আয়াতে তাঁর জিলহজ্জের প্রথম দশকের কসম করার দ্বারা এই দিনগুলোর মাহাত্ম্য বোঝা যায়। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দুনিয়ার সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ দিন হচ্ছে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন (কাশফুল আসতার, হাদীস-১১২৮)। আনাস (রা.) বলেছেন, কথিত আছে যে, ফযীলতের ক্ষেত্রে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন একহাজার দিনের সমান আর নবম দিনটি দশহাজার দিনের সমান (শুআবুল ঈমান, হাদীস-৩৪৮৮; সনদ দুর্বল)। এছাড়া আরো বিভিন্ন হাদীসের আলোকে বোঝা যায়, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমাযান মাসের পরে এই দশকই সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ। তবে কারো কারো মতে, এই দশকই বছরের সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ সময়। এমনকি রমাযানের শেষ দশকের চেয়েও বেশি। কেননা রমাযানের শেষ দশকে যেসব আমলের শরয়ি নির্দেশনা রয়েছে, যেমন, সিয়াম, সালাত, সাদকা ইত্যাদিÑ এই দশকেও সেসব আমলের নির্দেশনা রয়েছে। আর এই দশকে অতিরিক্ত রয়েছে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম পবিত্র হজ্জ। কেউ কেউ উভয়ের মাঝে সমন্বয় করেছেন এভাবে যে, রমাযানের শেষ দশকের রাতগুলো শ্রেষ্ঠ আর এই দশকের দিনগুলো শ্রেষ্ঠ (তাফসীরে ইবন কাসীর ৫/৪১৬)।

এই দশকের আমল:

কুরআন-সুন্নাহয় যেমন এই দশকের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে তেমনি বলা হয়েছে, এই দশকের আমল আল্লাহর কাছে সব থেকে বেশি প্রিয়। নবীজি (সা.) বলেন, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের নেক আমল আল্লাহ নিকট যত প্রিয় আর কোনো দিনের আমল তাঁর কাছে তত প্রিয় নয়। সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লার রাসূল, আল্লাহ রাস্তায় জিহাদও কি নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহ রাস্তার জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি জীবন ও সম্পদ নিয়ে জিাহাদে বের হয়ে গেল, আর ফিরে এল না (সহীহ বুখারি, হাদীস-৯৬৯; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৪৩৮; সুনান তিরমিযি, হাদীস-৭৫৭)। অন্য একটি দুর্বল সনদের হাদীসে বলা হয়েছে, এই দশদিনের নেক আমলের সাওয়াব সাতশত গুণ প্রদান করা হয় (শুআবুল ঈমান, হাদীস-৩৪৮১)।

এই দিনগুলোর নেক আমল যেহেতু আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়, সুতরাং আমাদের উচিৎ বেশি বেশি বিভিন্ন নেক আমল করা। এই হাদীসের ভিত্তিতে সকল ধরণের নেক আমলই করা যেতে পারে। তবে এই দশকের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে।

(ক) বেশি বেশি আল্লার যিকির করা

এই দিনগুলোতে বিশেষভাবে যিকিরের নির্দেশ দিয়ে মহান বলেন, “তারা যেন নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর যিকির করে।” (সূরা হাজ্জ, আয়াত: ২৮)। হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের চেয়ে অধিক মর্যাদাময় দিন যেমন আর আল্লার কাছে নেই, তেমনি নেক আমল করার জন্য তাঁর কাছে এই দিনগুলোর চেয়ে প্রিয় দিনও আর নেই। সুতরাং এই দিনগুলোতে তোমরা বেশি বেশি সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাহ, আল্লাহু আকবারÑ এই বাক্যগুলো বলে তাঁর যিকির করবে (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-৫৪৪৬; তাবারানি, কাবীর, হাদীস-১১১১৬)। সুতরাং এই দিনগুলোতে আমাদের বেশি বেশি মহান আল্লাহর যিকির বা স্মরণ করা উচিৎ। সাহাবি ইবন উমার (রা.) এবং আবু হুরাইরা (রা.) বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকবীর বলতে বলতে বাজারে যেতেন এবং তাঁদের তাকবীর শুনে লোকেরাও তাকবীর পড়ত (সহীহ বুখারি ২/২০)।

(খ) রোযা বা সিয়াম পালন করা

হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজি (সা.) এর জনৈকা স্ত্রী বলেছেন, নবীজি (সা.) জিলহজ্জের প্রথম দশকে রোযা রাখতেন (সুনান নাসায়ি, হাদীস-২৪১৮)। অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) চারটি আমল কখনো ছাড়তেন না। তার একটি হচ্ছে, এই দশকের রোযা (নাসায়ি-২৪১৬)।

এই দশকের খুবই ফযীলতপূর্ণ একটি দিন হচ্ছে নবম দিন, পরিভাষায় যাকে ইয়াওমে আরাফা বলা হয়। বিশেষ করে এই দিনটির রোযার ফযীলত খুবই বেশি। নবীজি (সা.) বলেছেন, আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী, তিনি আরাফার দিনের রোযার ওসিলায় পূর্বের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১৬২; সুনান তিরমিযি, হাদীস-৭৪৯)। হাদীসের মারফূ’ ও মাকতূ’ বর্ণনায় এসেছে, আরাফার দিনের রোযা একহাজার দিনের রোযার সমান (শুআবুল ঈমান, হাদীস-৩৪৮৬; ফাকিহি, আখবারু মাক্কাহ, হাদীস-২৭৬৬)।

সুতরাং আমরা চেষ্টা করব, জিলহজ্জ মাসের প্রথম নয়দিন রোযা রাখার। একান্ত অপারগ হলে অন্তত ঈদের আগের দিনের রোযাটা কিছুতেই ছাড়ব না।

(গ) ঈদের নামাযের পর চুল-নখ কাটা

বিশেষভাবে যারা কুরবানি করবেন আর সাধারণভাবে যারা কুরবানি করবেন নাÑ সকল মুসলিমের জন্যই এই দশকের একটি ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে, জিলহজ্জের চাঁদ উঠে গেলে চুল, নখ ইত্যাদি শরীরের অন্যান্য অবাঞ্চিত লোম পরিষ্কার না করে একেবারে ঈদের দিন ঈদের নামাযের পর কুরবানি করে তারপর পরিষ্কার করা। নবীজি (সা.) বলেন, যার কুরবানি আছে জিলহজ্জের চাঁদ উঠার পর কুরবানি না করা পর্যন্ত সে যেন তার চুল এবং নখ না কাটে (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১৯৭৭; সুনান তিরমিযি, হাদীস-১৫২৩)।

আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে কুরবানির সামর্থ্য না থাকা মুসলিমদের জন্যও এই নির্দেশনা এবং ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। নবীজি (সা.) বললেন, আমি আযহার দিন ঈদ পালন করতে আদিষ্ট হয়েছি; আল্লাহ তাকে এই উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। তখন একব্যক্তি বলল, দুগ্ধদানের একটি পশু ছাড়া আমার যদি আর কিছুই না থাকে তবে কি তা দ্বারাই আমি কুরবানি করব? নবীজি (সা.) বললেন, না। তুমি বরং তোমার চুল ও নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করবেÑ এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণ কুরবানি বলে বিবেচিত (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৭৮৯; সুনান নাসায়ি, হাদীস-৪৩৬৫)।

(ঘ) রাতের নফল নামায

এই দশকের আরেকটি ফযীলতপূর্ণ আমল হচ্ছে রাতের নফল নামায। একটি দুর্বল সনদের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের ইবাদত আল্লাহর কাছে অন্য যে কোনো সময়ের ইবাতের চেয়ে বেশি প্রিয়। এ সময়ের একদিনের রোযা এক বছরের রোযার সমতুল্য এবং প্রত্যেক রাতের নামায কদরের রাতের নামাযের সমতুল্য (সুনান তিরমিযি, হাদীস-৭৫৮; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-১৭২৮)।

(ঙ) গোনাহের কাজ বর্জন করা:

বছরের বারোটি মাসের মধ্যে চারটি মাস মহাসম্মানিতÑ জিলকদ, জিলহজ্জ, মুর্হারম ও রজব। এই মাসগুলোর মর্যাদা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ বলেন, “বছরের মাসগুলোর মধ্যে চারটি মাস মহাসম্মানিত... সুতরাং এই সম্মানিত মাসগুলোর মধ্যে তোমরা নিজেদের উপর যুলুম কোরো না।” (সূরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)। ‘তোমরা নিজেদের উপর যুলুম কোরো না’ বলে মূলত মহান আল্লাহ গোনাহ বর্জনের নির্দেশ দেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য, বিশেষ করে মহাসম্মানিত জিলহজ্জ মাসের এই দশকে খুব সর্তকতার সাথে সকল গোনাহ বর্জন করে চলব এবং উল্লিখিত বিশেষ আমলগুলোসহ সকল নেক আমল বেশি বেশি করার চেষ্টা করব। মহান আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন!!

দশম দিনের ফযীলত:

জিলহজ্জ মাসের দশম দিন ঈদুল আযহার দিন, ইসলামের পরিভাষায় এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুন নাহর’ বলে। এই দিনের ফযীলত ও আমল ‘ঈদের দিনের ফযীলত ও আমল’ শিরোনামে আলোচিত হয়ে থাকে। এ কারণে এই প্রবন্ধে আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করছি না। এই দিনটির ফযীলতে বর্ণিত শুধু একটি হাদীস উল্লেখ করে আমরা আমাদের আলোচনা শেষ করছি। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবন কুরত (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয় ফযীলতপূর্ণ ও মর্যাদাময় দিন হচ্ছে নাহর বা কুরবানির দিন (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১৭৬৫; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-১৯০৭৫)।

ইমদাদুল হক
দারুস সুন্নাহ
আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram