আয়েশা রা.-এর বিবাহ ও আপত্তির জবাব
![](https://samprotikee.com/wp-content/uploads/2022/07/IMG_20220705_094443.jpg)
মাওলানা শফীউল বাশার
![](https://samprotikee.com/wp-content/uploads/2022/07/IMG_20220705_094443.jpg)
হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব। আপনি স্বীকার করেন বা না করেন তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।
একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, রাসূল ﷺ ধর্ম প্রচার করার আগ পর্যন্ত তার কোন শত্রু বা নিন্দুকের জন্ম পৃথিবীতে হয় নি। যত শত্রু আর নিন্দুক জন্ম নিল তখন, যখন তিনি সমস্ত দেব-দেবী ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে আহবান করলেন। নতুন এক ধর্মের কথা মক্কাবাসীকে শোনালেন।
তাঁর এই দাওয়াতের ফলে মক্কার লোকগুলো নড়ে চড়ে বসলো। তারা প্রচণ্ড অতিষ্ঠ পরে হিংস্র হয়ে উঠলো । আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মাদ (ﷺ) কী এক নতুন ধর্মের অবতারণা করেছে, বলছে সব দেব-দেবী ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে। তারা অবলম্বন করলো তাঁকে দমানোর শত কৌশল। কোন লাভ হল না। তাঁর ও অনুসারীদের প্রতি চালালো নির্যাতনের স্টিম রুলার। তাতেও তারা কোন ফল পেল না। যখন হাজার অত্যাচার করেও তাঁকে একটুও দমানো গেলো না, তখন কুরাইশরা একটা মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিলো।
তারা ভেবে দেখল যে, কোন মানুষকে সাধারণত তিনটি জিনিস দিয়ে দমানো সম্ভব।
সম্পদ, নারী আর রাজত্ব- এই তিনটি বস্তু প্রাপ্তির জন্যই মানুষের যত সব হাঙ্গামা-দাঙ্গামা এই পৃথিবীতে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কুরাইশদের প্রতিনিধি হয়ে উতবাহ ইবনে রাবীআহ মুহাম্মদ ﷺ -এর কাছে গিয়ে বলল,
“যদি তুমি দারিদ্র্যের কারণে এমনটা করে থাকো তাহলে আমাদের বলো, আমরা অঢেল সম্পদ দিয়ে তোমাকে সমগ্র কুরাইশের মধ্যে সবচেয়ে ধনী বানিয়ে দিবো।
তুমি কি নেতৃত্ব চাও? বলো তো আমাদের নেতা বানিয়ে নিব; তোমাকে ছাড়া আমরা কোন সিদ্ধান্ত নেব না।
আর যদি নারী চাও, কুরাইশদের মধ্যে যাকে খুশি পছন্দ করো; আমরা দশজন নারীকে তোমার হাতে তুলে দিবো।”
কিন্তু তাতেও কোন লাভ হল না। কারণ, তিনি তো কাজ করছেন অমুখাপেক্ষী এক আল্লাহর জন্য। যার অন্তর এক আল্লাহর মহাব্বতে ভরপুর তাঁর অন্তর কি অন্য বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে? তাই এ সমস্ত প্রলোভনের প্রতি তার সামান্য পরিমাণ আগ্রহও সৃষ্টি হল না।
অবশেষে তারা কোন উপায়-উপায়ন্তর না দেখে তাঁকে পাগল, যাদুকর, ও কবির তকমা লাগিয়ে প্রোপাগান্ডা চলালো দেদারছে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল।
সেই প্রোপাগান্ডার ধারাবাহিকতা আছে কিন্তু বিষয় বস্তুর পরিবর্তন ঘটেছে।
বর্তমান ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার অন্যতম ও মুখ্য হাতিয়ার হল, রাসূল ﷺ কে নারীলোভী হিসেবে উপস্থাপন করা। কারণ, তাঁর ঘোর বিরুদ্ধচারীরাও জানে মুহাম্মদ ﷺ এর সম্পদের প্রতি বিন্দু মাত্র আসক্তি ছিল না। মৃত্যুর সময় তিনি একটা দিরহামও রেখে যাননি।
রাসূল ﷺ যদি সত্যিই নারীলোভী হতেন তবে কুরাইশের সেরা সেরা দশ নারীকে বিয়ে করার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম সুযোগ কি আর ছিলো? কিন্তু তিনি এই সুযোগ গ্রহণ করেননি।
তৎকালীন মক্কার মুশরিকরা তাঁকে পাগল, জাদুকর, কবি বলে অপপ্রচার করলেও কেউ কখনই তাঁকে নারীলোভী কিংবা শিশুকামী বলেনি। কারণ, তারা তাঁকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে। তাঁর শৈশব থেকেই প্রতিটি আচরণের সাথে তারা পরিচিত। যখন তাদের সংস্কৃতিতে অবৈধ যৌনাচার একদম বাজারের সস্তা পণ্য ছিল তখনো তিনি কোন নারীর নিকট কখনো গমন করা তো দূরের কথা কারো প্রতি চোখ তুলে কথা পর্যন্ত বলেন নি। মক্কার সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ হয়েও মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করেন ৪০ বছর বয়সী খাদিজা (রাঃ) কে। এই এক মধ্য বয়সী বিধবা নারীর সাথেই কাটিয়ে দিলেন যৌবনের শ্রেষ্ঠতম সময়।
খাদিজা (রাঃ) এর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে ঘর করেছেন একটানা ২৫ বছর। খাদীজা (রাঃ) এর ইন্তকালের সময় রাসূল ﷺ -এর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর।
তিনি তখন বিবাহ করলেন পঞ্চাশ বছর বয়সী সওদা (রাঃ) কে। তারপর আল্লাহর নির্দেশেই বিয়ে করেন ছয় বছর বয়সী আয়েশা (রাঃ) কে।
হিশাম ইবনে উরওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের তিন বছর আগে খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল হয়। তারপর দুই বছর বা এর কাছাকাছি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি আয়েশা (রা.) কে বিয়ে করেন। তখন তিনি ছিলেন ছয় বছরের বালিকা। তারপর ৯ বছর বয়সে বাসর যাপন করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৮৯৬)
তারপরেও তাঁর ঘোর শত্রুরা তাঁকে কখনো নারীলোভী কিংবা শিশুকামী বলেনি। কারণ তখনকার দিনে মেয়েদের এই বয়সেই বিবাহ হত। তৎকালীন শত্রুরা হয়তো ভুলেও কল্পনা করেনি যে, প্রায় চৌদ্দশ বছর পর তাদেরই মত কিছু ইসলামের শত্রু এটা নিয়ে এত আপত্তি করবে, এত জল ঘোলা করবে।
আয়েশা (রা.)-এর মাতা-পিতা স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময়ের কোনো মুসলিম কিংবা অমুসলিম শত্রু কিবা মিত্র এ বিয়ের প্রতিবাদ করেনি। কারণ, সে সময় মেয়েদের এ বয়সেই সাধারণত বিয়ে দেওয়া হতো।
ফ্রেঞ্চ ফিলোসফার Montesqueu তার ‘Spirit of Laws’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন,
উষ্ণ অঞ্চলে মেয়েরা ৮-৯-১০ বছর বয়সেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যায়। বিশ বছর বয়সে তাদেরকে বিয়ের জন্য বৃদ্ধ ভাবা হয়। উল্লেখ্য, ‘Spirit of Laws’ বইটি আমেরিকার সংবিধান তৈরীতে ব্যবহৃত হয়েছে।
আয়েশা (রাঃ) নিজেই মেয়েদের জন্য বিয়ের বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “মেয়ে যখন নয় বছরে উপনীত হয়ে যায়, তখন সে মহিলা হয়ে যায়।” [তিরমিযী]
তাই সে সময়কার আরব মেয়েদের জন্য নয় বছর বিয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল তার প্রমাণ ছিলেন স্বয়ং আয়েশা (রাঃ)।
মহানবী (ﷺ) আয়েশা (রা.)-কে প্রধানত তিনটি কারণে বিয়ে করেছিলেন।
এক. আবু বকর (রা.)-এর সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আত্মীয়তার বাঁধনে আবদ্ধ করা।
দুই. সব ইতিহাসবিদ এ ব্যাপারে একমত যে আয়েশা (রা.) ছিলেন তৎকালীন আরবের অন্যতম মেধাবী নারী। তিনি একাই ২২১০টি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা নারী হিসাবে তিনিই প্রথম। তাঁর মেধা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সবচাইতে ভাল জানতেন। তাইতো তিনিই তাঁকে বিবাহ করতে নির্দেশ দেন।
তাই মহানবী (সা.) তাঁর মাধ্যমে ইসলামের বিধিবিধান, বিশেষ করে নারীদের একান্ত বিষয়াদি উম্মতকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
তিন. মহানবী (সা.) তাঁকে বিয়ে করেছেন ওহির নির্দেশ অনুসরণ করে। ওহির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁকে বিয়ে করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) তাঁকে বলেছেন, দুইবার তোমার চেহারা আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। আমি দেখলাম, তুমি একটি রেশমি কাপড়ে আবৃতা এবং (জিবরাইল) আমাকে বলছেন, ইনি আপনার স্ত্রী, আমি ঘোমটাটা সরিয়ে দেখলাম। দেখি ওই নারী তো তুমিই। তখন আমি ভাবছিলাম, যদি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে তিনি তা বাস্তবায়িত করবেন। (বুখারি, হাদিস নং : ৩৮৯৫, ৫০৭৮ মুসলিম, হাদিস নং : ২৪৩৮)
আজ কিছু জ্ঞানপাপী রাসূল ﷺ-এর নামে কুৎসা রটনা করছে। অজ্ঞতাবশত তথাকথিত কিছু মুসলিমও তাদের সুরে সুর মিলিয়ে বলার চেষ্টা করে যে, রাসূল ﷺ আয়েশা (রাঃ) কে বিয়ে করে কাজটি ঠিক করেননি। মায়াযাল্লাহ।
রাসূল ﷺ আমাদের ঈমান, আমাদের বিশ্বাস। তিনি যা কিছু করেছেন আল্লাহর নির্দেশেই করেছেন। তাঁর বিরোধিতা মূলত আল্লাহর বিরোধিতা।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়। আল্লাহ তো তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি’ (সূরা আহজাব : ৫৭)।
‘তারা কি জানে না, কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করলে সিদ্ধান্ত স্থির রয়েছে যে, তার জন্য জাহান্নামের আগুন, যাতে সে সর্বদা থাকবে, এটা তো চরম লাঞ্ছনা! (সূরা তাওবা : ৬৩)
লেখক: মাওলানা শফীউল বাশার,
খতীব, হেমায়েতপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ,
মুহতামিম, মাদরাসাতুস সুন্নাহ,
হেমায়েতপুর, সাভার, ঢাকা।