পশু কুরবানি ও অন্তরের তাকওয়া
মাওলানা ইমদাদুল হক
সামর্থ্যবান ব্যক্তির উপর কুরবানি আবশ্যক। হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানি করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয় (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং-৮২৭৩; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীস-৭৫৬৫)।
কুরবানিতে মূল ইবাদত পশুর রক্ত ঝরানো, অর্থাৎ পশু জবাই করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কুরবানির দিন আল্লাহর নিকট বান্দার সবচেয়ে প্রিয় কাজ রক্ত ঝরানো, অর্থাৎ পশু জবাই করা। কুরবানির পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, লোম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকট এক বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। সুতরাং তোমরা আনন্দচিত্তে কুরবানি করো (সুনান তিরমিযি, হাদীস-১৪৯৩; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীস-৮৫২৩)।
কুরবানি আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে অন্তরের তাকওয়া এবং এটিকে শুধুই মহান আল্লাহর জন্য নিবেদন করা। অন্তরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকা। কুরবানি শব্দের অর্থ হচ্ছে নৈকট্য। শুধুমাত্র আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য যে কাজ করা হয় তাকে কুরবানি বলে।
মহান আল্লাহ বলেন, অতএব তুমি তোমার পালনকর্তার জন্যই সালাত আদায় করো এবং কুরবানি করো (সুরা কাওসার, আয়াত ২)। তিনি আরো বলেন, বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবকিছুই শুধুমাত্র বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য (সুরা আনআম, আয়াত ১৬২)। অন্যত্র তিনি বলেন, তার রক্ত-মাংস কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে কেবল তোমাদের অন্তরের তাকওয়া (সুরা হাজ্জ, আয়াত ৩৭)।
সুতরাং অন্যান্য ইবাদতের মতোই কুরবানি আল্লাহর নিকট কবুল হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ চিত্তে শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত হওয়া অপরিহার্য। অন্য কোনো উদ্দেশ্য মিশ্রিত থাকলে মহান আল্লাহ তা কবুল করবেন না। কিন্তু সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, অনেকেই কুরবানিতে ভিন্ন উদ্দেশ্য মিশ্রিত করে ফেলেন, বরং অন্য উদ্দেশ্যেই যেন কুরবানি করেন।
কেউ বড় পশু কিনে প্রদর্শন করে বেড়ান মানুষের কাছে নাম কেনার জন্য। কেউ আত্মীয় স্বজন দাওয়াত করে খাওয়ানোর জন্যই কুরবানি করেন। কুরবানির গোশত আত্মীয় স্বজনকে খাওয়ানো ইবাদত। তবে এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হলে, তখন আর কুরবানি থাকে না। কেউ কেউ পশু কেনার সময় থেকে গোশতের পড়তার হিসাব শুরু করেন। এ হিসাব কুরবানি জবাই পর্যন্ত চলতে থাকে। জবাইয়ের পর গোশত মেপে একে ওকে বলতে থাকে, আমার এত কেজি গোশত হয়েছে, এত টাকা করে পড়তা পড়ল। তাদের হাবভাবে মনে হয়, গোশতের পড়তাই যেন ইবাদত।
পশু কেনার সময় তো অবশ্যই পড়তা দেখে কিনতে হবে, যেন ঠকা না হয়। তবে ওটা তো ইবাদত নয়। গোশতের ঠকা-জিতের জন্য তো এ পশু কেনা হচ্ছে না। কেনা তো হচ্ছে আল্লাহর উদ্দেশে ইবাদতের জন্য। আল্লাহ তো অন্তরের তাকওয়া ও নিয়তের বিশুদ্ধতা দেখে ইবাদত কবুল করেন, গোশতের পড়তা দেখে নয়। আমি যদি ইবাদতের জন্যই কুরবানি করে থাকি তাহলে তো অন্তরের ওই তাকওয়ার দিকেই বারবার খেয়াল করব। সদা সতর্ক থাকব, বিশুদ্ধ নিয়তের অভাবে যেন আমার কুরবানি আল্লাহর নিকট কবুলের অনুপযুক্ত না হয়ে যায়।
কিন্তু সেদিকে খেয়াল না রেখে শুধু গোশতের পড়তার হিসাব কষা এবং এটাকেই একমাত্র আলোচ্য বিষয় বানানো অন্তরে বিশুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়ার অনুপস্থিতির দিকেই ইঙ্গিত করে। আর বিশুদ্ধ নিয়ত ও তাকওয়াহীন কোনো কর্ম আল্লাহ গ্রহণ করেন না। সুতরাং আমাদের ভাবা উচিত, আমাদের কুরবানি কি তবে শুধু গোশত খাওয়ার উৎসবে পরিণত হচ্ছে!
ইমদাদুল হক
দারুস সুন্নাহ, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা।