৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাহে রমাযান ও আল কুরআন

প্রতিনিধি :
ইমদাদুল হক
আপডেট :
এপ্রিল ৯, ২০২১
86
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

মাওলানা ইমদাদুল হক

রমাযান ও কদরের ফযীলতের কারণ:
রমাযান মাস বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক ফযীলতপূর্ণ মাস। এ মাসের অনন্য ফযীলতের কথা আমরা মুসলিম মাত্রই অবগত। কিন্তু রমাযান মাসের এতসব ফযীলত ও মাহাত্ম্যের কারণ কী? মহান আল্লাহ আল কুরআনে এ মাসের ফযীলত ও মাহাত্মের কারণ জানিয়ে বলেন, রমাযান এমন মাস, এ মাসে নাযিল হয়েছে কুরআন, যাতে রয়েছে মানবমণ্ডলীর জন্য পথের নির্দেশ আর হেদায়াত ও সত্যমিথ্যার পার্থক্যের সুস্পষ্ট বর্ণনা (সূরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৫)।

তেমনিভাবে শবে কদরের অনন্য ফযীলতের কথা আমরা জানি। এ রাতের ফযীলতের কারণ জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, আমি এ কুরআন নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। লাইলাতুল কদরের মাহাত্ম্য কী আপনি জানেন কি? কদরের এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম (সূরা কাদর, আয়াত: ১-৩)।
আল কুরআনের এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, রমাযান মাসের কদরের রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, কুরআনের সাথে এ সম্পৃক্ততার কারণেই রমাযান ও কদরের রাতের এ অনন্য মর্যাদা।

কুরআনের সম্পৃক্ততায় মানুষের মাহাত্ম্য:
আল কুরআন নাযিল হয়েছে রমাযান মাসের কদরের রাতে, তবে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য; আর আল কুরআন বারবার সম্বোধন করেছে মানুষকে। আল কুরআনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে যদি মাহে রমাযান ও শবে কদরের এরূপ মর্যাদা সাব্যস্ত হয় তাহলে যে মানুষকে উদ্দেশ্য করে তা নাযিল হয়েছে সেই মানুষ যদি কুরআনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে তার মর্যাদা কীরূপ হতে পারে!
ওহির মাধ্যমে জানা যায় কুরআনের সাথে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে মাটির মানুষও মর্যাদায় অনন্য হয়ে ওঠে। আল কুরআনের পাঠক ও শিক্ষক হচ্ছেন পৃথিবীর অন্যসব মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ মানুষ। উসমান ইবন আফফান (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয় (সহীহ বুখারি, হাদীস-৫০২৭; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১৪৫২; সুনান তিরমিযি, হাদীস-২৯০৭; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-২১১)।
এই মাটির মানুষ যখন কুরআনের জ্ঞানে দক্ষ হয় তখন সে নূরের ফেরেশতার সমতুল্য হয়ে ওঠে। আয়িশা (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কুরআনের জ্ঞানে দক্ষ ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট করে কুরআন পড়ে, তার জন্য রয়েছে দুটি প্রতিদান (সহীহ মুসলিম, হাদীস-৭৯৮; সহীহ বুখারি, হাদীস-৪৯৩৭; সুনান আবু দাঊদ, হাদীস-১৪৫৪; সুনান তিরমিযি, হাদীস-২৯০৪; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-৩৭৭৯)।
সর্বোপরি কুরআনের সাথে নিবিড় ও গভীর সম্পর্কের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি যখন কুরআন-ওয়ালা মানুষে পরিণত হয় তখন এই সৃষ্ট মানুষই মহান স্রষ্টার পরিজন ও খাস ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আনাস ইবন মালিক (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) বললেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর কিছু আহ্ল বা পরিজন রয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসূল, তারা কারা? তিনি বললেন, আল কুরআনের পরিজনই মহান আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশিষ্ট জন (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-১২২৯২; মুসনাদ তায়ালিসি, হাদীস-২২৩৮; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-২১৫)।

কুরআন পরিত্যাগের পরিণতি:
জাবির (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কুরআন এমন সুপারিশকারী যার সুপারিশ অবশ্যগ্রাহ্য; এমন বিবাদী যার দাবি অনস্বীকার্য। যে তাকে ইমাম বানাবে কুরআন তাকে নেতৃত্ব দিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাবে আর যে তাকে পেছনে ফেলে রাখবে তাকে জাহান্নামে টেনে নিয়ে যাবে (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, হাদীস-১৮৫৫; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীস-১২৪)।
মহান আল্লাহ বলেন, আর রাসূল বলবেন, হে আমার প্রতিপালক, আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছে (সূরা ফুরকান, আয়াত: ৩০)।
সুতরাং কুরআনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন অত্যাবশ্যকীয়; এটা ঐচ্ছিক কোনো বিষয় নয়। মহান আল্লাহ মানুষের মুক্তির জন্য কিতাব ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসে আমরা দেখছি, এই কিতাব ও রাসূল উভয়েই কুরআন পরিত্যাগকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট অভিযোগ দায়ের করছেন। সুতরাং মুক্তির জন্য কুরআনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

রমাযানে নবীজির কুরআন পাঠ:
আল কুরআনের পঠন ও অনুধাবন, কুরআনের বিধান প্রতিপালন ও প্রতিষ্ঠাই ছিল নবীজি (সা.) এর জীবনের একমাত্র ব্রত। সা’দ ইবন হিশাম বলেন, আমি আয়িশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন, নবীজি (সা.) এর জীবনপ্রণালি কেমন ছিল? তিনি বললেন, তাঁর জীবনপ্রণালি ছিল আল কুরআন (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-২৪৬০১; সহীহ মুসলিম, হাদীস-৭৪৬)।
এমনতর কুরআন অন্তপ্রাণ জীবন হওয়া সত্ত্বেও রমাযানে নবীজি (সা.) কুরআনকে আরো বেশি সময় দিতেন। ইবন আব্বাস (রা.) বলেনে, নবীজি (সা.) সকলের চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। রমাযানে জিবরীল (আ.) যখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমাযানের শেষ পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরীল (আ.) আগমন করতেন আর নবীজি (সা.) তাঁকে কুরআন শোনাতেন (সহীহ বুখারি, হাদীস-৬, ১৯০২; সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৩০৮)।

উমার (রা.) কর্তৃক পুনরায় তারাবীহর জামাআত চালু:
আমরা জানি, রাসূল (সা.) অল্প কয়েক দিন জামাআতে তারাবীহ পড়েছেন। তারপর বাদ দেন। উমার (রা.) পুনরায় তাঁর খিলাফতকালে জামাআত চালু করেন। উমার রা. কর্তৃক পুনরায় জামাআত চালুর উদ্দেশ্যও দীর্ঘ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কুরআন তিলাওয়াত। রমাযানের একরাতে তিনি মসজিদে গেলেন। তখন লোকেরা বিক্ষিপ্ত ছিল। কেউ একা একা, আবার কিছু লোক কোনো ইমামের পিছে সালাত আদায় করছে। তিনি তাদেরকে এক ইমামের পিছে একত্রিত করতে চাইলেন।
তাবিয়ি আবুল আলিয়া বলেন, উমার (রা.) উবাই ইবন কা’ব (রা.)-কে রমাযানে লোকদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করতে আদেশ দিয়ে বললেন, লোকেরা দিনভর সিয়াম পালন করে তবে, তারা সুন্দর করে কুরআন পড়তে পারে না, যদি আপনি রাতে তাদের নিয়ে কুরআন পড়তেন। তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন, এভাবে তো আগে হয় নি। তিনি বললেন, আমি জানি, তবে কাজটি উত্তম। এরপর উবাই রা. তাদের নিয়ে বিশ রাকআত (তারাবীহ) পড়লেন। (মাকদিসি, আল আহাদীসুল মুখতারাহ, হাদীস-১১৬১)। এছাড়া আরো অন্যান্য হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, তারাবীহর জামাআতের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য পঠন ও শ্রবণের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় কুরআনের সান্নিধ্যে কাটানো।

আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, নবীজি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি শরীআত নিষিদ্ধ কথাকর্ম ও অজ্ঞতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে মহান আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই (সহীহ বুখারি, হাদীস-৬০৫৭; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-৯৮৩৯; সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-১৬৮৯)।
সুতরাং রোযা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অজ্ঞতা পরিহার জরুরি। আর ওহির জ্ঞান অর্জন ছাড়া অজ্ঞতা দূর করার কোনো বিকল্প পদ্ধতি নেই। তাই আসুন, কুরআন নাযিলের মাস রমাযানে আমরা ব্যাপক আকারে কুরআনের চর্চায় মনোনিবেশ করি। মহান আল্লাহ তাওফীক দিন। আমীন।

ইমদাদুল হক; দারুস সুন্নাহ; আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram