১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারদীর পানব্যবসায়ি আব্দুস সবুর হত্যাকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে আদালতে স্বীকারুক্তি দিলেন বোমারু জামাল

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
নভেম্বর ২৯, ২০২০
136
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 


আলমডাঙ্গার হারদী গ্রামের পানব্যবসায়ি আব্দুস সবুর (৩৭) হত্যাকান্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারুক্তি দিলেন হারদীর জামাল হোসেন ওরফে বোমারু জামাল ওরফে শুটার জামাল (৩৭)। শুধুমাত্র পাওনা বেতনের টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পেয়ে গুলি করে হত্যা করা হত্যা করা হয় তাকে। ২৭ নভেম্বর রাতে পুলিশ তাকে ও হত্যাকান্ডে জড়িত একই গ্রামের কাবের আলীকে (৪০) আটক করেছে। আটকের পর তাদেরকে ২৮ নভেম্বর আদালতে হাজির করা হয়। ইতোপূর্বে ২৩ নভেম্বর এ হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে নিহতের চাচা শ্বশুর ও পারিবারিক ভ্যানচালক কিরণকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের স্বীকারুক্তি মোতাবেক জামাল ও কাবের আলীকে আটক করা হয়।

জানা যায়, গত বছরের ২২ জুন রাতে আলমডাঙ্গার হারদী গ্রামের আব্দুস সবুর (৩৬) নামের এক পানব্যবসায়ি যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ভোরে নিজ ঘরের খাট থেকে তার লাশ পুলিশ উদ্ধার করে। হত্যাকান্ডের পর আব্দুস সবুরের স্ত্রী সালমা খাতুন জানান, আব্দুস সবুর যে রুমে রাত কাটাতেন তার পাশের রুমে সন্তানসহ তিনি(স্ত্রী) থাকতেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষে আব্দুস সবুর সাধারণত রাত ১টা / দেড়টার দিকে বাড়ি ফিরতেন। বাড়ি ফিরে তিনি তাকে (স্ত্রীকে) ডেকে তুলতেন। কিন্তু ঘটনার রাতে তার আচরণের ব্যত্যয় ঘটে। ২১ জুন রাত ১০টার দিকে আব্দুস সবুর বাড়ি থেকে খেয়ে স্ত্রী সালমা খাতুনের নিকট থেকে ১ শ টাকা চেয়ে নিয়ে বাইরে যায়। কখন ফিরে এসেছিলেন তা তিনি জানতে পারেননি। ভোর ৩টার দিকে একটা শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে সময় তিনি নিজের রুম থেকে বের হয়ে স্বামীর ( আব্দুস সবুরের) রুমে যেতে চেষ্টা করেও পারেননি। কেউ বাইরে থেকে তার রুমের দরজার শেকল আগে থেকেই আটকে দিয়েছিল। সে সময় তার চিৎকারে প্রতিবেশিরা ছুটে গিয়ে তার রুমের শেকল খুলে দেয়। তিনি রুম থেকে বের হয়ে দেখেন স্বামীর রুমের দরজা খোলা। ভেতরে গিয়ে খাটে শুয়ে থাকা অবস্থায় স্বামী আব্দুস সবুরের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পান।


আব্দুস সবুরকে শাবল বা ভারি কোন কিছু দিয়ে কপালে আঘাত করে হত্যা করা হতে পারে বলে পুলিশ প্রথমিকভাবে ধারণা করেছিল। কিন্তু ময়না তদন্তকারি চিকিৎসকের বক্তব্য পুলিশের ধারণা পালটে দেয়। ময়নাতদন্তকারি চিকিৎসক আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার শামীম কবীর জানান, শর্টগান অথবা ওয়ান শুটার গানের গুলিতে আব্দুস সবুরের মৃত্যু ঘটেছে। তার মস্তিষ্কের ভেতরে শর্টগান বা ওয়ান শুটার গানের গুলির ৩৬টি স্পিন্ডার পাওয়া গিয়েছিল। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে সেসময় আলমডাঙ্গা থানায় এজাহার দায়ের করে। তবে সে এজাহারে কাউকে আসামি বা সন্দেহ করা হয়নি।


তবে পুলিশ ঘটনার দিনেই হারদী গ্রামের মৃত কালু মন্ডলের ছেলে মনির ও একই গ্রামের মৃত কলিম উদ্দীনের ছেলে আতিয়ারকে আটক করে। তারা দুজনেই নিহত আব্দুস সবুরের বন্ধু। সে সময় পুলিশ তাদের নিকট থেকে এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে কোন তথ্য উদ্ধার করতে পারে না।


দীর্ঘ ১ বছরের অধিক সময়েও পুলিশ এ হত্যাকান্ডের রহস্যের কোন কুল কিনারা করতে পারে নাই। সাধারন মানুষও সবুর হত্যাকান্ডের কথা ভুলতে বসেছিল। কিন্তু আলমডাঙ্গা থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ আলমগীর কবীরে নির্দেশনায় ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ এ হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এরই প্রেক্ষিতে সবুর হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হল।


নিহত সবুর গভীর রাত অবধি তিনি সবান্ধবে নেশা করতেন। নিজের উপার্জন তো বটেই, তার স্ত্রীর বেতনের টাকাও দেদারচ্ছে উড়াতেন নেশার পেছনে। আব্দুস সবুরের স্ত্রী সালমা খাতুন পল্লীবিদ্যূত সমিতির আলমডাঙ্গা অফিসে কর্মরত। এই নেশা করা নিয়ে স্ত্রীর সাথেও তার সম্পর্কের অবনতি ছিল। হত্যাকান্ডের ১০/১২ দিন আগে স্ত্রীকে পিটিয়ে আহত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। এ বিষয়টি জানার পর পুলিশের বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে, পারিবারিক অশান্তিই এ হত্যাকান্ডের কারণ হতে পারে। এ বিষটি সামনে নিয়ে পুলিশ ব্যাপক তদন্ত শুরু করে। নিহতের ও তার ঘনিষ্ঠদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করা হয়। যে সব নাম্বার থেকে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত যোগাযোগ করা হয়েছে তাদেরকে টার্গেট করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। এক পর্যায়ে এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের পরিচয় বের হয়ে আসে বলে একটি সূত্র দাবি করে।


গত ২৩ নভেম্বর রাতে পুলিশ এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কুমারীডাঙ্গা গ্রামের মৃত জহির উদ্দীনের ছেলে শফি উদ্দীনকে (৫০) আটক করে। আটক শফি উদ্দীন নিহত আব্দুস সবুরের চাচা শ্বশুর। পরে একই রাতে হারদী গ্রামের রিকন শেখের ছেলে পাখিভ্যান চালক কিরণ শেখকে (২১) আটক করেছে। আটক কিরণ শেখের ভ্যানে নিহত আব্দুস সবুরের শিশু সন্তান ও স্ত্রী যাতায়াত করতেন। তাদেরকে আটক করতে পুলিশকে বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করতে হয় বলে জানা যায়। তারা এ হত্যাকান্ডের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ তত্থ্য দেয়।


তাদের স্বীকারুক্তি মোতাবেক গত ২৭ নভেম্বর রাতে পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত মাসুদুর রহমান, এস আই খসরু আলম, এস আই সুফল কুমার, কনস্টেবল শাহরিয়ার ও রফিকুল ইসলামসহ সঙ্গীয় ফোর্স জামাল হোসেন ওরফে বোমা জামাল ওরফে শুটার জামালকে তার মামাবাড়ি আলমডাঙ্গার গোবিন্দপুর থেকে আটক। একই রাতে নিজ বাড়ি থেকে ডাকাত কাবেরকে আটক করে। জামাল হারদী গ্রামের কাতব আলীর ছেলে ও কাবের আলী একই গ্রামের মেছের আলীর ছেলে। রাতেই তাদেরকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হতে শুরু করে। পরদিন ২৮ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করা হলে জামাল হোসেন নিজেকে হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারুক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছেন বলে জানা যায়।
একাধিকসূত্রে জানা যায়, সবুর হত্যাকান্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত জামাল হোসেন ওরফে বোমা জামাল ওরফে শুটার জামাল ও ডাকাত কাবের দুজনই নিহত সবুরের ঘনিষ্ঠজন। তারা তিনজনই একসময় আন্ডার ওয়াল্ডের নটরাজ হারদী গ্রামের সন্ত্রাসি আরিফের সহযোগি ছিলেন। আরিফের সকল অপকর্মের সাথি।

বোমাঘাতে আরিফ নিহত হওয়ার পর সবুর পানব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার কর্মচারি হিসেবে রাখেন পুরনো বন্ধু বোমারু জামাল ও ডাকাত কাবের আলীকে। বিয়ের পর সুদর্শন সবুর পল্লি বিদ্যূতের চাকুরি পাওয়া সালমা খাতুনকে অনেকটা ট্রাপে ফেলে বিয়ে করেন। অবশ্য এর পূর্বে সালমা খাতুন একাধিক বার অন্যান্য যুবককে বিয়ে করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। বিয়ের পরও মাত্রাতিরিক্ত মদ পান অব্যাহত রাখে সবুর। বেহিসেবি সবুর ব্যবসার পুঁজি সবই শেষ করে ফেলেন। স্ত্রীর বেতন সব খরচ করে ফেলতেন। বেশ কয়েক বার শ্বশুরের নিকট থেকেও টাকা নেয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত শ্বশুর লোন নিয়ে তাকে টাকা দেন। সব অর্থ নেশার পথে খরচ করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তার কর্মচারি জামাল ও কাবের আলীর কয়েক মাসে বেতন বাকী হয়ে যায়। এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। নিহত হওয়ার ১০/১২ দিন আগে সবুর স্ত্রীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। এরপর সবুর হত্যার চূড়ান্ত বøুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়। হত্যার জন্য সবুরের চাচা শ্বশুর শফি উদ্দীন আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেন। সবুরের পারিবারিক পাখিভ্যান চালক কিরণ গিয়ে চাচা শ্বশুরের বাড়ি থেকে কাঠালভর্তি দুটি বস্তা নিয়ে সবুরের বাড়িতে যায়। একটি বস্তায় আগ্নেয়াস্ত্র একটি ওয়ান শুটারগান লুকিয়ে নিয়ে আসা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসার জন্য ওই দিন হত্যার নেপথ্য অবস্থানকারি পাখিভ্যান চালক কিরণকে অসংখ্য বার রিং দেন।


ঘটনার রাতে জামাল, কাবের, কিরণসহ ১০/১২ জন যুবক সবুর আলীকে কৌশলে রাত ১০/ সাড়ে ১০টার দিকে মাঠে নিয়ে যায়। তাকে উপর্যপুরি মাদ পান করায়। এক পর্যায়ে সবুর সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অজ্ঞান অবস্থায় ঘাড়ে করে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পথের ভেতর অজ্ঞান অবস্থায় বমি করেন। পরে নিজের ঘরের বেডে শুইয়ে রাখা হয়। সে সময় সবুর ছিল মৃতপ্রায়। ঘাতকদের ধারণা ছিল - এমনিতে সবুরের অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে তিনি মারা যেতেন। কিন্তু ঘাতকরা কোন রিস্ক নিতে চায়নি। তাই মাথায় নল ঠেকিয়ে ঠান্ডা মাথায় তাকে খুন করা হয়। কাবের নিজে শুট করে। ঘাতকরা চলে যাওয়ার আগে সবুরের স্ত্রীর রুমের দরজার শেকল বাইরে থেকে তুলে দেন।


আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন জানান, জামাল, কাবের ও কিরণ নিহত সবুরের নিকট কয়েক মাস বেতন পেতেন। শুধুমাত্র বকেয়া বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ঘাতকরা এ হত্যাকান্ড ঘটায়। তবে কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে সম্পর্কে মুখ খোলেন নি।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram