আশুরার সাথে তাসুআর রোযা : উম্মাহর স্বাতন্ত্র্যের শিক্ষা

মাওলানা ইমদাদুল হক
ইসলামপূর্ব সময়েও আশুরার দিনটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী দিনটিকে নানাভাবে উৎযাপন করত। ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, মক্কার কুরাইশ ও খয়বারবাসীদের নিকট দিনটির বিশেষ আবেদন ছিল। হাদীস শরীফে এ সম্পর্কে বেশকিছু বর্ণনা এসেছে।
আয়িশা (রা.) বলেন, জাহিলিয়াতের সময়ে কুরাইশরা (জাহিলিয়াতবাসী) আশুরার দিন সিয়াম পালন করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামও জাহিলিয়াতের সময় এই দিনে সিয়াম পালন করতেন। এবং তাদের একটি দিন ছিল, যেদিন তারা কাবাগৃহে গিলাফ পরাত (সহীহ বুখারি, হাদীস-১৫৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১২৬; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৪৪২)।
আবু মুসা আশআরি (রা.) বলেন, আশুরার দিনকে ইয়াহুদিরা সম্মান করত এবং এদিনে তারা ঈদ উৎযাপন করত (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১৩১)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, খয়বারবাসী আশুরার দিন সিয়াম পালন করত এবং ঈদ উৎযাপন করত আর তাদের নারীদেরকে অলঙ্কারাদি ও সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদে বিশেষভাবে সজ্জিত করত (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১৩১)।
ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, (হিজরতের পর এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল,) ইয়াহুদি-খ্রিস্টানগণ এই দিনটিকে সম্মান করে থাকে (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১৩৪; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৪৪৫)।
আয়িশা (রা.) বর্ণিত হাদীস থেকে আমরা জেনেছি, ইসলামপূর্বকালে নবীজিও এই দিনে সিয়াম পালন করেছে। ইবন উমারের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সাহাবিগণও সেসময়ে এই দিনে সিয়াম পালন করতেন। তিনি বলেন, আশুরার দিনটিতে তো জাহিলিয়াতের সময়েও আমরা সিয়াম পালন করেছি (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৪৪৩)।
আশুরার দিনের বিশেষ ইবাদত সিয়াম বা রোযার রয়েছে তিনটি পর্ব। ১. ইসলামপূর্ব জাহিলি সমাজের রোযা, ২. মদীনায় হিজরতের পর রমজানের রোযা ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত অবস্থা এবং ৩. রমজানের রোযা ফরয হওয়ার পরের অবস্থা। এসব অবস্থার বিস্তারিত পর্যালোচনা আমাদের আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমরা এ লেখায় দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করব।
আমরা দেখলাম, ইসলামপূর্ব সময় থেকেই আশুরার এদিনটি ছিল বিশেষভাবে সম্মানিত। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী দিনটি বিভিন্নভাবে উৎযাপন করত এবং সিয়াম পালন করত। এমনকি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামও জাহিলিয়াতের সময়ে এদিনে সিয়াম পালন করতেন। সাহাবিদেরও অনেকেই জাহিলিয়াতের সময়ে এদিনে রোযা রেখেছেন। তবে ইসলামে এদিনের সিয়ামের বিশেষ নির্দেশনা আসে হিজরতের পর। তার রয়েছে বিশেষ প্রেক্ষাপট।
ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরত করে গিয়ে দেখতে পান ইয়াহুদিরা আশুরার দিন রোযা রাখছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, এদিনে কেন তোমরা রোযা রাখ? তারা বলল, এটা মহান কল্যাণময় একটা দিন। এদিনে মহান আল্লাহ তাঁর নবী মুসা ও তাঁর কওম বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে মুক্তি দেন এবং ফিরআউনের সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মারেন। তাই মুসা (আ.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোযা পালন করেন। আর আমরা তাঁর সম্মানার্থে রোযা রাখি। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, তবে তো তোমাদের চেয়ে মুসা (আ.)-এর অনুসরণের আমরাই অধিক হকদার ও উপযুক্ত। ফলে তিনি রোযা রাখেন এবং সাহাবিদেরকে রোযা রাখার আদেশ করেন (সহীহ বুখারি, হাদীস-৩৩৯৭, ৩৯৪৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১৩০; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৪৪৪)।
এ সময় থেকে রমজানের রোযা ফরয হওয়া পর্যন্ত মুসলিম সমাজে আশুরার রোযা ফরয রোযার গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হত। কিন্তু আমরা এখন আশুরার দিনের সাথে তার আগের দিনও রোযা রেখে থাকি। সাহাবিগণও এদিন রোযা রাখতেন। এটা ইসলামেরই বিধান। আশুরার দিনের রোযার ইতিহাস আমরা জানলাম। কিন্তু তার আগের দিন, যাকে পরিভাষায় তাসুআ বলা হয়, এদিনের রোযার ইতিহাস ও তাৎপর্য কী? এ দিকটির রহস্য উন্মোচনই আমাদের আজকের লেখার উদ্দেশ্য।
তাসুআ মানে নয় তারিখ। আশুরার সিয়ামের সাথে মুহাররমের নয় তারিখ তাসুআর সিয়ামেরও নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। উপরের আলোচনা থেকে আমরা আশুরার রোযার গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝতে পারলাম। কিন্তু তাসুআর রোযা কেন? কোনো জাতি-গোষ্ঠীর পৃথিবীর বুকে সম্মানের সাথে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন উন্নত সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট। যে জাতির সংস্কৃতি যত উন্নত এবং বৈশিষ্টগুলো যত স্বতন্ত্র সে জাতি তত সম্মানিত এবং তাদের স্থায়িত্বও ততটাই বেশি। যে জাতির ভিনসংস্কৃতি মোকাবালা করার উন্নত শক্তিশালী সংস্কৃতি নেই, যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পারে না, বরং পরজাতির নির্বিচার অনুকরণ করে তারা সম্মান ও ঔজ্জ্বল্য খুইয়ে মলিন ও এক সময় অন্যের মাঝে বিলীন হয়ে যায়।
ইসলাম মানব জাতির মুক্তির জন্য আল্লাহর দেওয়া সর্বশেষ পয়গাম। তাই কিয়ামত পর্যন্ত এর সগৌরব স্থায়িত্ব জরুরি। এজন্য তার অনিবার্য নিয়ামক হিসাবে ইসলামের রয়েছে উন্নত সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট। মুসলিম জাতির এখন প্রয়োজন এই সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্যের সচেতন চর্চা এবং শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মোকাবালা। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা সর্বতভাবে মুশরিকদের মোকাবালা করো, যেমন তারা সর্বতভাবে তোমাদের মোকাবালা করে; আর জেনে রাখো, আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে আছেন (সূরা তাওবাহ, আয়াত ৩৬)।
সাহাবি কিরাম রা. নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে থেকে এই শিক্ষা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। আশুরার সিয়াম তাদের পালন করতে হচ্ছিল আল্লাহর নবী মুসা (আ.)-এর স্মৃতির স্মরণ এবং আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কর্ম ও আদেশের অনুসরণের জন্য। তবুও তো দৃশ্যত বিষয়টি ইয়াহুদি-খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতির সাথে মিলে যাচ্ছিল। তখনই তাদের মাঝে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগ্রত হয়ে ওঠে।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আশুরার দিন রোযা রাখলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখার আদেশ করলেন তখন সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ দিনটিকে তো ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা সম্মান করে? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগামী বছর নবম তারিখেও আমি রোযা রাখব, ইনশাআল্লাহ (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১১৩৪; সুনান আবু দাউদ, হাদীস-২৪৪৫)।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের শিক্ষার আলোকে ইবন আব্বাস (রা.) লোকদেরকে এভাবেই শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমরা মুহাররমের নয় ও দশ তারিখ সিয়াম পালন করবে এবং এভাবে ইয়াহুদিদের বিরুদ্ধাচারণ করবে (সুনান তিরমিযি, হাদীস-৭৫৫)।
এটাই হচ্ছে আশুরার সাথে তাসুআর রোযা রাখার রহস্য, উম্মাহর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সম্মানিত খতিব মাওলানা আবদুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ বলেন, আশুরার রোযার সঙ্গে ৯ মুহাররমের রোযা রাখাও ভালো। বরং আশুরার সঙ্গে যদি ৯ বা ১১ মুহাররমে রোযা রাখা তাহলে আরো ভালো (মাসিক আলকাউসার, অক্টোবর ২০১৮, পৃষ্ঠা: ০৬)।
ইসলাম এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার মুসলিম উম্মাহকে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলার শিক্ষা, নির্দেশ ও নির্দেশনা প্রদান করেছে। স্বাতন্ত্র্য রক্ষা ছাড়া যে কোনো ব্যক্তি ও জাতি নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না, সে কথাও সুস্পষ্ট করে বলেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেছেন, যে অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই হয়ে যায় (সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪০৩১)। সাহাবিগণ বিষয়টি যথাযথ অনুধাবন এবং প্রতিপালন করেছিলেন। তাই তাঁরা ছিলেন বিজয়ী। আর আমরা এখন অন্যের নির্বিচার অনুসরণ-অনুকরণের মধ্যে আভিজাত্য খুঁজি। আমাদের বর্তমান অধপতিত অবস্থার এটাও একটি বড় কারণ।
লেখক: মুহতামিম, দারুস সুন্নাহ একাডেমি, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা।