জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ আব্দুল রাজ্জাক আজ পঙ্গু, ব্যথায় জর্জর এক বিপ্লবী জীবন

রহমান মুকুল /শরিফুল ইসলাম রোকন: রাজপথের প্রতিবাদ থেকে আজ বিছানার নিঃসঙ্গ কারাগারে বন্দি আব্দুল রাজ্জাক। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়া এই মানুষটি এখন জীবনযুদ্ধে পুরোপুরি পঙ্গু। তাঁর আক্ষেপে, তাঁর চোখের জলে একটা দেশের বিবেক যেন প্রশ্নের মুখে।
আব্দুল রাজ্জাক আলমডাঙ্গা উপজেলার বক্সিপুর গ্রামের মৃত নিজাম উদ্দিনের ছেলে। একদিন যিনি ছিলেন রাজধানীর গাজীপুর বোর্ড বাজারের ব্যস্ততম রাস্তায় ছেলুনের দোকানের কর্মী, আজ তা শুধুই স্মৃতি একজন পঙ্গু পিতা, একজন পরাজিত যোদ্ধা।
বাঁধভাঙা ভিড়ের সেই দিন ছিল ৫ আগস্ট, রাজপথ জনতার ¯েøাগানে উত্তাল। আব্দুল রাজ্জাক গণভবনের উদ্দেশ্যে বিজয়মিছিলে শামিল হন। মিছিল পৌঁছায় উত্তরা থানার সামনে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। তিনটি গুলি তাঁর শরীরে: দুটি পিঠ ও কাঁধে, একটি অÐকোষে। অসহ্য যন্ত্রণায় ভেঙে পড়া রাজ্জাককে ছাত্র-জনতা উদ্ধার করে নিয়ে যায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারে জীবন বাঁচালেও পুলিশের গুলি কেড়ে নেয় স্বাভাবিকভাবে চলার শক্তি, কেড়ে নেয় এক পুরুষের সম্মানবোধ, কেড়ে নেয় পাঁচ সদস্যের একমাত্র আশ্রয়দাতা হওয়ার সামর্থ্য।
গত ১৬ জুন, সোমবার সেই আব্দুল রাজ্জাক এসে দাঁড়ান আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলামের দরজায়। কান্না চাপা দিয়ে শুধু বলেন,“আমি আর পারি না, ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না। পেটের দায়ে বাঁচতে চাই।"
আব্দুল রাজ্জাক বলেন, “আমি ঢাকায় বাসা ভাড়া করে স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক পুত্রকে নিয়ে থাকতাম। প্রায় নয় মাস কোনও কাজ করতে পারছি না। গ্রামে ফিরে এলাম, কিন্তু ভিটে-মাটি কিছুই নেই। ছোটবোন মায়ের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। এখন শুধু অন্ধকার।"
জুলাই ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাওয়া দুই লাখ টাকা ইতোমধ্যে নিঃশেষ। দোকানের কাজে অভ্যস্ত এই মানুষটি আর কোনও কাজে পারদর্শী নন।
তবু জীবনের ভার বইতে হচ্ছে তাকে স্ত্রীর শূন্য দৃষ্টির সামনে, সন্তানের অভুক্ত মুখের সামনে।
আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলাম জানান, “ আব্দুল রাজ্জাক জুলাই আন্দোলনে আহতদের মধ্যে তালিকাভুক্ত। তাঁর স্থায়ী নিবাস যেহেতু আলমডাঙ্গায়, তিনি চাইলে আমরা গ্রামেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করব। সব ধরনের সহযোগিতা পাবেন তিনি।”
একটি রাষ্ট্র যখন তার নাগরিককে রাজপথে থাকার উৎসাহ দেয়, প্রতিবাদের গর্ব শেখায় সেই রাষ্ট্রই যদি গুলিতে পঙ্গু করা একজন বিপ্লবীকে ভুলে যায়, তবে কাকে বলে ন্যায়ের শাসন?
আব্দুল রাজ্জাক নিজেই এখন এক জীবন্ত প্রশ্ন: একটি গুলির মূল্য কত? একটি পুরুষত্ব হারানোর ক্ষতিপূরণ কী? একটি পঙ্গু জীবনের দায় কে নেবে?