১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উইগ্রো'র আর্লি কিং ভুট্টার বীজে ভেদামারী গ্রামে সর্বনাশ, ঘরে ঘরে কান্না।। প্রতিকার চেয়ে মানববন্ধন

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
মে ৪, ২০২৫
55
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 


মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন আলমডাঙ্গার ভেদামারী গ্রামের কৃষকরা। গত ২ মে শুক্রবার তারা মানববন্ধন করেন। উইগ্রো নামের একটি কৃষিভিত্তিক কোম্পানীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন ভেদামারী গ্রামের ১২ কৃষক। ওই কোম্পানীর প্রলোভনে পড়ে ব্যাংক লোন নিয়ে তাদের দেওয়া সার বীজ সংগ্রহ করে চাষাবাদ করলেও ফলন হয়নি আশানুরুপ। একদিকে কৃষকরা চাষে হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগী কৃষকরা পড়েছেন মহা বিপাকে।


“বউমার গয়নাগুলো বন্ধক রাখছি, তাও কিস্তির টাকা যোগাড় হয় না,” কথাগুলো বলতে বলতে চোখ মুছছিলেন আলমডাঙ্গার ভেদামারী গ্রামের কৃষক মানোয়ার হোসেন (৪৬)।


চার বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদের স্বপ্ন ছিল তার, নতুন জাতের বীজে ভালো ফলনের আশা ছিল, সেইসঙ্গে বেশি দামে বিক্রির নিশ্চয়তা। কিন্তু সবই আজ শুধু গলার কাঁটা।


এবছর ভুট্টা আবাদের পূর্বে উইগ্রো নামের একটি কৃষি ভিত্তিক কোম্পানীর এরিয়া ম্যানেজার মোজাম্মেল হক গ্রামে আসে। সে জানায় সার, বীজ, কীটনাশক ও কৃষিবীমা সবই দেবে। শুধু একটি ব্যাংকের লোন নিতে হবে, যেটি তারাই করে দেবে। লোনও হলো, এক লাখ টাকা। কিন্তু পুরো টাকা হাতে পেলেন না মানোয়ার। কোম্পানির হিসাবমতে ৩৬ হাজার টাকা কেটে রেখে বাকিটা হাতে পেলেন।


“বলা হয়েছিল, এই বীজে হবে বেশি ফলন,” বলছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মানোয়ার, “কিন্তু নিজের চোখে দেখলাম, চার বিঘায় যা ফলন হয়েছে তা দুই বিঘার সমানও না।” পাশের জমিতে বাজারের সাধারণ বীজে যেখানে ৪০ মণ পর্যন্ত ভুট্টা হয়েছে, সেখানে মানোয়ার হোসেন পেয়েছেন সর্বোচ্চ ২৩ মণ।


শুধু ফলনের ধাক্কাই নয়। সামান্য বাতাসে তার ক্ষেত শুয়ে পড়েছে। অথচ, পাশের ক্ষেত ঠিকই দাঁড়িয়ে ছিল। বীমার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত সেই টাকাও পাননি তিনি। “প্রতিদিন ফোন দিচ্ছি, কোনো উত্তর নাই,” বলেন মানোয়ার, “ কোম্পানির লোকেরা তো আর আসে না। রিং দিলেও কথা বলে না।”


উইগ্রো নামের কৃষি-প্রযুক্তি কোম্পানির প্রলোভনে পড়ে এখন তিনি সর্বস্বান্ত। মাথার ওপরে ঋণের বোঝা, পেছনে পড়ে আছে ভাঙা স্বপ্নের ভুট্টাক্ষেত। সামনে শুধু অনিশ্চয়তা।


এখন প্রতিমাসে কিস্তির সময় আসে। অথচ ঘরে অভাব, মেয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হচ্ছে, দোকানে বাকি বেড়েছে। “ ছোট ছেলেটা জিজ্ঞেস করে, আব্বা এবার ঈদে নতুন জামা হবে না?” কণ্ঠটা ভেঙে আসে মানোয়ার হোসেনের।


এই এক মানোয়ার হোসেনই নয়, এমন দুর্দশায় পড়েছেন ভেদামারী গ্রামের কৃষক রোকনুজ্জামান, আব্দুর রাজ্জাক, জিয়াউর রহমান, ঝন্টু রহমান, আব্দুল হান্নান,জনি আহম্মেদ,মনজুর রহমান, আনিসুর রহমান, ইমন আলী, মন্টুর রহমান । উইগ্রো কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলে তারা গত ২ মে মানববন্ধনও করেছেন। প্রশাসনের কাছে তদন্ত ও ক্ষতিপূরণ দাবি জানিয়েছেন।


“মাটির সাথে বিশ্বাস করে চাষ করি,” বল্লেন ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কৃষক ঝন্টু রহমান, “কিন্তু মানুষ এত বড় ফাঁদ পেতে বসে থাকবে, ভাবিনি কখনো।” তার এখন একটাই চাওয়া ক্ষতিপূরণ আর বিচার। যেন আর কোনো কৃষক এমন সর্বনাশের মুখোমুখি না হয়।


“প্রতিবছর ধার করে হলেও চাষ করি, কিন্তু এবার ভাবলাম একটু আধুনিক পদ্ধতিতে করব,” বলছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কৃষক আব্দুল হান্নান। “তারা বলেছিল, উচ্চফলনশীল জাত। প্রতি বিঘায় ৪০/৪৫ মণ ফলন হবে। আবার বাজারে দাম কমলেও তারা ভালো দামে কিনবে। তাই সবার মত আমিও ৪ বিঘা ভুট্টা আবাদ করেছিলাম।" সেই স্বপ্নের শুরু, আর আজকের বাস্তবতা একেবারে বিপরীত মেরুতে। মাঠে গিয়ে দেখা যায়, আব্দুল হান্নানের চার বিঘা জমির ভুট্টাক্ষেতের অর্ধেক গাছই বাতাসে পড়ে গেছে। ফলন হয়েছে বিঘা প্রতি মাত্র ২০-২২ মণ।


“এত কম ফলন জীবনে দেখিনি,” হতাশার সুরে বলেন তিনি, “বীজটাই ভালো ছিল না। ছড়া ছোট, দানা চিটের মতন। বাতাসে পড়েও গেল সহজে। অথচ পাশের জমির সাধারণ জাতের গাছের কিছু হয়নি।”


আব্দুল হান্নানের আরেক দুশ্চিন্তার নাম লোন। প্রতি মাসে ব্যাংকের কিস্তি দিতেই হবে। ঘরের মালামাল বন্ধক রাখা ছাড়া উপায় নেই বলে মন্তব্য করলেন তিনি।


ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অভিযোগ, উইগ্রো কোম্পানি তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। বীমার টাকা কেটে নেওয়া হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়নি। এখন কোম্পানির মোবাইল নম্বরেও আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তারা একের পর এক ফোন দিলেও কোম্পানীর মুন্সিগঞ্জে অফিসে দ্বায়িত্বরত সাব্বির হোসেন ও শামসুর রহমানের কেউ ফোন ধরছেন না বলে তাদের অভিযোগ।


“ ফোনে রিং যায়, কিন্তু কেউ ধরে না,” বলছিলেন একই গ্রামের কৃষক মাসুদ পারভেজ, “আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত, সেটা জানার পর থেকেই আর দেখা নেই কোম্পানির লোকজনের।”


এই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে গত ২মে মানববন্ধনে নেমেছেন ভেদামারী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত ১২ জন কৃষক। ভেদামারী মাঠে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ভূট্টাক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে তারা কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে ¯েøাগান দেন।


মানববন্ধনে উপস্থিত কৃষকরা বলেন, “আমরা চাই প্রশাসন এই প্রতারণার তদন্ত করুক। যারা আমাদের সর্বনাশ করেছে, তাদের বিচার হোক। আমাদের ক্ষতিপূরণ দিক। ব্যাংক লোন মাফ করে দিক।"


মানোয়ারের মতো অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মানববন্ধন থেকে শুধু একটি জিনিস চাইছেন প্রতারকদের শাস্তি আর ক্ষতিপূরণ। যাতে অন্তত আবার চাষের জমিনে দাঁড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পান তারা।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram