১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গানে গানে " সোনার মানুষ" হওয়ার বাসনা শ্রোতাদের হৃদয়ে জ্বেলে দিলেন বাউল আব্দুল লতিফ শাহ ও তার দল

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
এপ্রিল ১৯, ২০২৫
36
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

রহমান মুকুল: "জন্মের সময় আমরা জন্তু হয়ে জন্মাই। কিন্তু সংস্কৃতিই আমাদের মানুষে পরিণত করে।" কথাটি বলেছিলেন গবেষক গোলাম মুরশিদ।


আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যে সঙ্গীত প্রধান অঙ্গ। সবচে' প্রভাবশালীও। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রাণ বাঁধা লোকসংগীতে। বাউল-ভাটিয়ারী-ভাওয়াইয়া-মুর্শিদীর সুরে। একটা কথা প্রচলিত আছে যে -- একমাত্র সঙ্গীতই পারে মানুষকে তার আত্মার কাছে নিয়ে যেতে।" বাউল ও মুর্শিদীর ক্ষেত্রেই মনে হয় কথাটি বেশি উপযুক্ত।


বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রশাসন আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী লোকজ সাংস্কৃতিক মেলা। মেলার দ্বিতীয় দিনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাউল শিল্পী আব্দুল লতিফ শাহ ও তার দল। আব্দুল লতিফ শাহ একুশে পদকপ্রাপ্ত মরমী সুরসাধক প্রয়াত প্রখ্যাত বাউল খোদাবক্স শাহ'র ছেলে ও "মনের মানুষ" চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী। তিনি খোদাবক্স শাহ স্মৃতি পরিষদের পক্ষ থেকে এ পরিবেশনায় অংশ নেন।


সঙ্গীত মানুষের মনে কল্পনার জগত তৈরি করে। একসময় মানুষ রেডিও-তে গান শুনতো আর কাহিনী কল্পনা করে নিতো। এখন প্রযুক্তির নানা উৎকর্ষে টিভি ও মোবাইলফোনের ভিন্ন ভিন্ন রুচির সমৃদ্ধ গান দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে যা তাদের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত নানামুখী চেতনার যোগান দিচ্ছে। বর্তমানে শহরে জীবন ও সংস্কৃতিতে শিশুরা ঘরে বন্দিদশায় বড় হচ্ছে। যা তাদের মানসিকতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা অনেকেই ধৈর্যহীন ও আক্রমণাত্মক হয়ে বেড়ে উঠছে। এক্ষেত্রে সুন্দর ও সুস্থ সংস্কৃতির গান হতে পারে অন্যতম নিয়ামক।


খোদাবক্স শাহ'র "বন্ধুর জ্বালায় আমি কোথায় যাব।" সমেবেত কণ্ঠে এই সঙ্গীতটি দিয়ে পরিবেশনা শুরু হয়।
মূলত বাউল-ধারার এ গানে প্রেম মানেই ঈশ্বর-ভক্তি, প্রেম মানেই আত্মার আকুলতা।


গানটি একদিকে প্রেম-বিরহের গীতি, আবার অন্যদিকে এটি ভক্তিরূপে রূপান্তরিত আকুল আত্মসন্ধান। সাধক ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যাঁর প্রেমে তিনি জ্বলছেন, আবার দূরত্ব বা বিরহ তাঁর জ্বালার কারণ।


লতিফ শাহ গাইলেন, "ধন্য ধন্য বলি তারে" এই লালন গীতির মধ্যে এক গভীর দর্শন ও আত্মোপলব্ধির বাণী নিহিত। যে নিজের ভেতরের আত্মাকে চিনতে পারে, সে প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী, দিব্যজ্ঞানী।


লালনের মতে, আত্মোপলব্ধি, আত্ম-চিন্তন ও নিজের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করাই হলো জীবনের মূল লক্ষ্য।

বাইরের আড়ম্বরে ডুবে না থেকে যদি মানুষ নিজের অন্তরকে জানে, তবেই সে সত্যিকারের ধন্য, সোনার মানুষ।
এরপর গাইলেন "মিলন হবে কত দিনে" এই গীতি যেন আধ্যাত্মিক আবেদন এবং গভীর দার্শনিক ভাবনার অনুরণন। "মিলন" কথাটিকে শুধু পার্থিব প্রেম বা মানুষের সঙ্গে মিলনের অর্থে না নিয়ে, আত্মা ও পরমাত্মার মিলন, বা সাধকের সাধ্য-সাধনার পর চূড়ান্ত আত্মবোধের রূপ। আর "মনের মানুষ" এখানে অন্তরের ঈশ্বর চেতনা, যাঁকে একজন সাধক অনুভব করতে সাধন ভজন করেন।


সব মানুষই গান শোনেন, সুন্দর সমাজ গড়তে হলে গান শোনার প্রয়োজন। গান মানুষকে সুন্দর করে। একটি সুন্দর গান মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।


অতএব, আমাদের সামগ্রিক গরজে আউলবাউল লোকসাহিত্যের সন্ধান, সংগ্রহ, সরক্ষণ ও গবেষণাকর্ম অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন। নতুবা আজোবধি যা-কিছু গ্রামাঞ্চলের মানুষের মুখে ও স্মৃতিতে টিকে আছে, তাও আমরা হারাব।


সমস্ত অনুষ্ঠানজুড়ে নান্দনিক, মননশীল ও সপ্রতিভ সঞ্চালনায় ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, প্রভাষক একেএম ফারুক হোসেন ও এমদাদ হোসেন। সুন্দর আয়োজনের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলামের প্রতি আন্তরিক শুভকামনা।


শেষ পরিবেশনা ছিল -- " পোষা পাখি চিনলাম না,/ এ দু:খ তো যাবে না।"
" পোষা পাখি" না চেনার গভীর বেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram