নিভে গেল আলমডাঙ্গার রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের সবচে' উজ্জ্বলতম নক্ষত্র

আলমডাঙ্গা বিএনপির বটবৃক্ষ হিসেবে পরিচিত মীর মহি উদ্দীন মারা গেছেন (ইন্না ইলাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। দীর্ঘ দিন রোগে ভুগে গত শুক্রবার দিনগত রাত ২ টায় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। আলমডাঙ্গার রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের সবচে' উজ্জ্বলতম নক্ষত্র নিভে গেল। ৫ এপ্রিল শনিবার বাদ যোহর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দারুস সালাম কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
প্রায় ৬/৭ মাস পূর্বে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। স্ট্রোকে আক্রান্তের বিষয়টি তিনি প্রথমে বুঝতে পারেননি। পরে শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হলে নিউরো সাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার চিকিৎসাধীন রেখে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব না হলে ইন্ডিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানেও রোগ নির্নয় সম্ভব হয়নি। তবে লক্ষণের সাথে বিরল এক রোগের মিল আছে বলে জানানো হয়েছিল। তবে বিরল রোগের চিকিৎসা সম্ভব হয়নি। আক্রান্তের ২৪ ঘন্টার ভেতর অপারেশনের প্রয়োজন ছিল বলে চিকিৎসকদের অভিমত। পরে, দেশে ফিরিয়ে এনে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছিল। ওই অবস্থায় গত ৪ এপ্রিল দিন গতরাত ২ টায় তিনি মারা যান।
ভোরে লাশ নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাদ জোহর গার্ড অব অনার প্রদান ও জানাযার নামাজ শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আলমডাঙ্গা দারুস সালাম কবরস্থানে আব্বা-আম্মার কবরের পাশে তাকেও শায়িত করা হয়। আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলামের উপস্থিতিতে এ গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ পরির্দশক তদন্ত আজগর আলী নেতৃত্বে জেলা পুলিশের এক চৌকস টিম এ গার্ড অব অনার প্রদান করে।
শেষ চৈত্রের তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করে মরহুমের জানাযায় উল্লেখযোগ্য মানুষের সমাগম ঘটে। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌর প্রশাসক শেখ মেহেদী ইসলাম, জেলা জামায়াতের আমীর রহুল আমীন, জেলা বিএনপির সাধারন সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ, জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাড. ওয়াহেদুজ্জামান বুলা, জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য আব্দুর জব্বার সোনা, সর্দ্দার আলী হোসেন, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা ফরিদুল ইসলাম শিপলু, সফিকুল ইসলাম পিটু, জেলা জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি অ্যাড. মাসুদ পারভেজ রাসেল, সাবেক পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী, সাবেক পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হেলাল উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. আব্দুর রশিদ মোল্লা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাসেম মাস্টার, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী মাস্টার, উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আক্তার হোসেন জোয়ার্দ্দার, সাধারন সম্পাদক আমিনুল হক রোকন, পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজুর রহমান পিন্টু, সাধারন সম্পাদক জিল্লুর রহমান অল্টু, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারন সম্পাদক শেখ সাইফুল ইসলাম, আসির”ল ইসলাম সেলিম, উপজেলা জামায়াতের আমীর প্রভাষক শফিউল আলম বকুল, সেক্রেটারি মামুন রেজা, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সদস্য এমদাদুল হক ডাবু, সার ব্যবসায়ী হাজী আকবার আলী, হাজী রফিকুল ইসলাম, হাজী হার”ন অর রশিদ, আসিফ আল নুর তামিমসহ জেলা, আঞ্চলিক মোটর মালিক সমিতির সেক্রেটারি সেকেন্দার আলী, উপজেলা ও পৌর বিএনপিসহ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবকদল, অঙ্গ সংগঠনের সকল নেতাকর্মি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
মীর মহি উদ্দীন আলমডাঙ্গা শহরের প্রবীন মিলব্যবসায়ী প্রয়াত আলহাজ্ব মীর খোস্তার আলী ও প্রয়াত আবেদা বেগমের সেজ সন্তান ছিলেন। মরহুমের সহধর্মিণী জিয়াউন নাহার আলমডাঙ্গা মহিলা ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তাঁর দুই কন্যা সন্তান। দু'মেয়েই চিকিৎসক। তারা সার্বক্ষনিক দেখভাল করছেন। মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনায় স্ত্রী জিয়াউন নাহার ও ভাতিজা মীর আসাদুজ্জামান উজ্জ্বল সকলের নিকট দু'আ চেয়েছেন।
এদিকে, মীর মহি উদ্দীনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে ও তার শোককাতর পরিবারের প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও মারফত সমবেদনা প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসভাপতি শামসুজ্জামান দুদু, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান শরিফ, সিনিয়র সহসভাপতি আক্তার হোসেন জোয়ার্দার, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রোকন, পৌর সভাপতি আজিজুর রহমান পিন্টু, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ওল্টু, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সদস্য এমদাদুল হক ডাবু। তার মৃত্যুতে জাতীয়তাবাদী শক্তির অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
অনুরূপ পৃথক শোকবার্তা পাঠিয়েছেন জেলা জামায়াতের আমীর রুহুল আমিন ও আলমডাঙ্গা উপজেলা আমীর প্রভাষক শফিউল আলম বকুল।
আলমডাঙ্গা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আকবর আলী, রফিকুল ইসলাম মিয়া, আব্দুল বারী, আসিফ আল নুর তানিম আঞ্চলিক মটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী অনুরূপ শোকবার্তা দেন। আলমডাঙ্গা সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে অনুরূপ শোক প্রকাশ করা হয়েছে।
মীর মহি উদ্দীন আলমডাঙ্গা বিএনপির অপরিহার্য এক নাম। ভোটের হিসেব নিকেষে নির্ভুল সমীকরণের শিক্ষক ছিলেন মীর মহি উদ্দীন। নেতাকর্মীদের মাঝে হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মত সম্মোহন সৃষ্টি করতে পারতেন।
মীর মহি উদ্দীন আলমডাঙ্গা পৌরসভার দুই ট্রাম মেয়র ছিলেন। ২০০৩ সালে ১ম বার। তারপরের বারও তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি পৌরসভাকে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে শহরে ড্রেন নির্মাণ, পানি সাপ্লায়ের প্রক্রিয়া করেন। এছাড়া, বাস টার্মিনাল নির্মাণ, জান্নাতুল বাকী নামক পৃথক পৌর গোরস্থান, ক্যানেলে গোসলের জন্য বেশ কিছু পাকা ঘাট নির্মাণ, শহীদ মিনার নির্মাণ, স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ করেন। তিনি পৌর শহরে অনেক মসজিদ-,মন্দির নির্মাণ ও পুণর্র্নিমাণ করেছেন। পৌর এলাকা আলোকিত করতে বিদ্যুত সুবিধা দ্বার গোড়ায় পৌছে দিতে তিনি ছিলেন অনন্য। সমালোচনা যতই থাক, অন্তত এ সব কাজের জন্য মানুষ তাঁকে স্মরণ করবেন।
আরেকটি কাজের জন্য আলমডাঙ্গা অঞ্চলে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সেটি হল - শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি আলমডাঙ্গা মহিলা ডিগ্রী কলেজ, আলমডাঙ্গা পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনায়েতপুর বাড়াদী মীর খোস্তার আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আমেনা বেগম প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নির্মাণ করেন। এছাড়াও, বেলগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চরপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জগন্নাথপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খাসকররা কলেজ ও জামজামি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখেন।
নির্দ্বিধায় বলা যায় যে মীর মহি উদ্দীন তাঁর সময়ের অন্যান্যদের চেয়ে অধিক গতিশীল ছিলেন। তিনি এক সাথে বিভিন্ন ধরণের কাজে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন। শিক্ষায়, শ্রমে ও মেধায় তিনি অন্য রাজনীতিকদের চে' এগিয়ে ছিলেন বলেই তিনি ছিলেন সবক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সফল্যের অধিকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় তিনি অতিরিক্ত সুবিধা পেতেন। বিশেষ করে মন্ত্রণালয়সহ অফিসিয়াল কাজে। তাঁর অনেক সহপাঠী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে। তিনি কখনও থানায় ও চায়ের দোকানে বসতেন না। এ বৈশিষ্ট্য ছিল প্রশংসনীয়। আইন আদালত ও অফিসিয়াল কাজে তিনি ছিলেন পুরো জেলায় অনন্য।
ব্যবসায়ী হিসেবে মীর মহি উদ্দীন ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি বর্তমানে জেলা ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। এক সময় তিনি এ সংগঠণের বিভাগীয় সভাপতি ছিলেন। গত দুই যুগে যারা সারের ডিলার হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ মীর মহি উদ্দীনের হাত ধরে।
ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন সফল, ঠিক তেমনই দানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উপোড় হাত। মেয়র না থাকলেও আলমডাঙ্গায় তিনি সবচে বেশি দান করতেন। প্রতি শীত ও ঈদে তিনি কয়েক হাজার দরিদ্রদের কম্বল, শাড়ি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, শার্ট ও নগদ টাকা বিতরণ করতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করেছেন। এ সব কারণে মীর মহি উদ্দীনের বিকল্প মীর মহি উদ্দীন নিজেই।
ধর্মীয় কর্মকান্ডেও প্রয়াত আলহাজ্ব মীর মহি উদ্দীন ছিলেন অগ্রগামী। তিনি দীর্ঘদিন আলমডাঙ্গা পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সভাপতি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন