আলমডাঙ্গার পিঠা উৎসব: আমাদের ঐতিহ্যাধিকারের এক উজ্জ্বল স্বারক

রহমান মুকুল: নবান্নের পর জাঁকিয়ে শীত পড়লে পৌষ-মাঘে পিঠা তৈরির আয়োজন করা হয়। বসন্তের আগমন পর্যন্ত চলে হরেক রকম পিঠা খাওয়ার ধুম। মূলত মাঘ-ফাল্গুন এ দুমাসই জমিয়ে পিঠা খাওয়া হয়। গরমের সাথে সাথে আর পিঠার স্বাদ ঠিকমতো পাওয়া যায় না।
জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখ। হালকা শীতের মোহনীয় আবেশ। সন্ধ্যার গাঢ়ত্বের সাথে সাথে এ আমেজ যেন আরও বেশি উপাদেয় হয়ে উঠে। সন্ধ্যার পিঠা উৎসব যেন জনাকীর্ণ। নানা স্বাদের, নানান নামের পিঠার স্বাদ আস্বাদন করতে মোটেও কার্পণ্য নেই তরুণ সমাজের।
আলমডাঙ্গায় দুদিনব্যাপী পিঠা উৎসবের আয়োজন করেছে আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রশাসন। গত ২১ জানুয়ারি এ উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আশীষ কুমার বসু। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, পিঠা-পায়েস মুখরোচক খাদ্য হিসেবে বাঙালি সমাজে আদরণীয়। আত্মীয়স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পিঠা-পুলির উৎসব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া, পিঠাপুলির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত করিয়ে দেবে।"
মেলায় অনেকগুলি স্টল। তার মধ্যে পিঠাপুলির স্টল ১০ টির মত। পরিচিত, অপরিচিত নানা ধরণের পিঠার সম্ভার শোভা পাচ্ছিল স্টলগুলোতে।
নিজের নামে " প্রান্তি আউটফিট" নামে স্টল সাজিয়ে বসেছেন অনার্স ৩ য় বর্ষের ছাত্রী ফাহমিদা প্রান্তী। তাকে সহযোগিতা করছিলেন আরেক তরুণী ও এক কিছুটা বয়স্ক মহিলা। এ স্টলটিতে ভীড় ছিল লক্ষ্যনীয়।
পাশেই আরেক লাস্যময়ী তরুণীর স্টল। অবশ্য তার সঙ্গে এসেছেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা সবাই হাস্যজ্বল তরুণীকে সাহায্য করতে দেখা গেছে।
স্টলগুলিতে ঢু মারতে মারতে অতীতের স্মৃতি রোমস্থন করতে চলে গেছে মন। কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটাতেন পিঠা তৈরিতে। অতিথি বিশেষ করে জামাইদের এ সময় দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হতো। এ সময় খেজুরের রস, গুড়, পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠতো!
বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, মনসামঙ্গল কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকায় কাজল রেখা গল্পকথনের সূত্র ধরে আনুমানিক ৫০০ বছর আগেও বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
কাজেই ধরে নেওয়া যায় পিঠা খাওয়ার প্রচলন বাঙালি সমাজে অনেক প্রাচীন। বাঙালির লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই।
মেলায় সবান্ধব ঘুরছিলেন আলমডাঙ্গা বণিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন। তিনি জানান, আলমডাঙ্গায় মানুষের বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই। এক দিন নির্মল একটু আনন্দের জন্য অন্যান্যের মত তিনিও এই মেলার এসেছেন। মেলাটির স্থায়িত্বকাল বৃদ্ধির প্রয়োজন বলে জানান। এতে উদ্যোগক্তাদেরও কল্যাণ হবে বলে মন্তব্য করেন। মেলার কলেবরও বৃদ্ধি প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন।
শুধু সরকারি নির্দেশনায় এত সর্বাঙ্গসুন্দর মেলার আয়োজন অসম্ভব। নিশ্চয় এর সাথে আয়োজকের প্রাণের স্পন্দনের ঐক্যতান জড়িয়ে একাকার হয়ে আছে। এদিক বিবেচনায় আয়োজক উপজেলার নির্বাহী অফিসার শেখ মেহেদী ইসলাম সকলের সমীহ প্রত্যাশা করতেই পারেন। পিঠা উৎসব সম্পর্কে তিনি বলেন, 'পিঠা-পুলি আমাদের লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই প্রকাশ। আমাদের হাজারো সমস্যা সত্তে¡ও গ্রামবাংলায় এসব পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে।"