বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় বীর শহীদ মেজর বজলুল হুদা'র ৭৬ তম জন্মবার্ষিকী পালিত

মুর্শিদ কলিন/সোহেল হুদা: বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় বীর শহীদ মেজর বজলুল হুদা'র ৭৬ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। দীর্ঘদিন পর গতকাল ১৯ জানুয়ারি মেজর বজলুল হুদা'র পরিবার ও এলাকাবাসী মেজর হুদার ৭৬ তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছে। এ উপলক্ষে হাটবোয়ালিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। দোয়া পরিচালনা করেন হাফেজ মাওলানা মুফতি সাঈদ হাসান সালিম।
স্বদেশের টানে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের দুর্গম সীমান্ত অতিক্রম করে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন মেজর বজলুল হুদা।
২নং সেক্টর " কে' ফোর্সের অধীনে অসম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ পরিচালনাকারী সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে অবিস্মরণীয় ভুমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানীর পিএস ছিলেন। '৭৫ -র সফল বিপ্লবের পর সুযোগ্য ডিপ্লোম্যাট, জাতীয় সংসদ সদস্য, ঐতিহাসিক আগষ্ট বিপ্লবের মহান নায়ক, ফ্রীডম পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল ছিলেন। এই বিপ্লবী জননেতা জাতীয় বীর শহীদ মেজর বজলুল হুদা'র ৭৬তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আত্মার প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়েছে এলাকাবাসী।
প্রসঙ্গত, জন্মঃ ১৯ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে হাট বোয়ালিয়া গ্রামে। শৈশব থেকে অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলেটির শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হাট বোয়ালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে ইন্টেরমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে (English Honours)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত থাকাকালীন সেনাবাহিনীর নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং মনোস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় রেকর্ড মার্কস পেয়ে সেনাবাহিনীর দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সের (long course) জন্য মনোনীত হন।
১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে ( PMA) যোগদান করেন। দু’বছরের প্রশিক্ষণ (Long Course) সমাপ্ত করে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে কমিশন প্রাপ্ত হন। এই প্রশিক্ষণ কালের শেষদিকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধের প্রথম থেকেই তিনি মরিয়া হয়ে বিভিন্ন উপায়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন।
বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন পথে পালিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকেন। কমিশন প্রাপ্তির পর তার পোস্টিং হয় ঝিলাম সেনানিবাসে। কাকুল থেকে ঝিলাম যাবার পথে পালিয়ে দেশে আসার চেষ্টা করে আবারও ব্যর্থ হন। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা অনুযায়ী সরাসরি ঝিলামের দিকে না যেয়ে অন্য পথে যাওয়ার দÐস্বরূপ তার সিনিয়রিটি ছ’মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়।
কিছুদিন পরেই ঝিলাম থেকে তাঁকে পাঠানো হয় করাচির মালির সেনানিবাসে। সেখানে লাইট এ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট বিধ্বংসী প্রশিক্ষণে যোগ দেন। এই প্রশিক্ষণের শেষ পর্যায়ে সেনা কর্মকর্তার পরিচয় গোপন করে করাচি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে আইডি কার্ড সংগ্রহ করে জীবন বাজী রেখে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন।
যশোর থেকে মেহেরপুর হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর কাছে রিপোর্ট করেন (১৯৭৫ সালে তিনি জেনারেল ওসমানীর পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন)। ১৯৭১ সালে তিনিই সম্ভবত একমাত্র বাঙ্গালী অফিসার যিনি মাত্র ২০/২১ বছর বয়সে দল বেঁধে নয় সম্পূর্ণ একাকী জীবনকে হাতের মুঠোই নিয়ে পাকিস্তান আর্মি থেকে চলে আসেন ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও। তাঁর আগে এবং পরে কিছু আর্মি অফিসার পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করেন কিন্তু একাকী নন, সঙ্গীদের সাথে নিয়ে।
স্বাধীনতার পর ময়নামতি সেনানিবাসে তিনি প্রথম গোলন্দাজ বাহিনীতে আডজুট্যান্ড হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর অসীম বুদ্ধিমত্তা, অসাধারণ প্রজ্ঞা, সাহস, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, এক মহাসাগর সমপরিমাণ জ্ঞান তাঁকে অতি অল্পবয়সে পৌঁছে দেয় অনেক উপরে। একমাত্র তিনিই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সর্বকনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন হিসেবে, 'ক্যাপ্টেন টু মেজর' পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৭৫ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি ক্যাপ্টেন থেকে মেজর পদে প্রোমোশন পান এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সবচেয়ে স্মার্ট অফিসার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন.। ১৯৭৪ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে কোর্স করতে ইংল্যান্ড পাঠানো হয়। কোর্স শেষে পরীক্ষায় তিনি আন্তর্জাতিক স্টুডেন্টদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে দেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখেন !! দেশে ফিরে আসার পর তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান তাঁকে বিদেশে অসাধারণ রেজাল্ট করার স্বীকৃতিস্বরূপ Commendation লেটার প্রদান করেন।
তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছাঃ তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালীন নিজ গ্রামে মাথাভাঙ্গা নদীর উপর বহু প্রত্যাশিত এবং বহু প্রতীক্ষিত ব্রিজ তৈরি হয় তাঁরই নিরলস প্রচেষ্টায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের " কন্ডেমসেল" থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন পূর্ণিমার রাতে তিনি প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত ধরে মাথাভাঙ্গা নদীর ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে জোস্না দেখবেন' !
এই ক্ষণজন্মা অসাধারণ মানুষটির অন্য সব ইচ্ছার মতো ' স্ত্রীর হাত ধরে জোস্না দেখার ইচ্ছেটিও অপূর্ণ রয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত !! তিনি তাঁর লেখা কবিতার বই, " চলো বেড়িয়ে আসি" তে বারবার উল্ল্যেখ করেছেন, ' জীবনের কাছে খুব বেশী চাওয়া নেই আমার" !!
আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন অসাধারণ অথচ জীবনযাপন ছিল অতি সাধারণ !!!