চুয়াডাঙ্গা জেলার সফল নারী জয়িতা হলেন কহিনূর বেগম
রহমান মুকুল: তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্মেছিলেন। জমিদার তনয়া তিনি। মাত্র ৩ বছর বয়সে বাপকে হারান। বেড়ে উঠেছিলেন জমিদার দাদার অপত্য স্নেহচ্ছায়ায়। দেখতে দেখতে জমিদার নন্দিনী সোমত্ত হয়ে উঠলেন। উপযুক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন প্রভাবশালী দাদা। মুস্কিল হল শিক্ষিত ছেলে পাওয়া। শিক্ষিত ছেলে ছাড়া অর্ধ শিক্ষিত ধনীর দুলালের সাথে তিনি প্রিয় নাতনিকে পাত্রস্থ করতে নারাজ। চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান আমলে কুষ্টিয়া জেলার প্রত্যন্ত রাধানগর গ্রামে এক উচ্চ শিক্ষিত ছেলের সন্ধান পেলেন। ছেলে শিক্ষিত অথচ দরিদ্র। দূরদর্শী জমিদার দাদা শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সুশিক্ষিত বজলুর রহমানের সাথেই আদর আহ্লাদে লালিত নাতনি কহিনূর বেগমের বিয়ে দিয়েছিলেন। আলোচ্য কহিনূর বেগমই আজকের মহীয়সী জননী জয়িতা। একজন সফল মা ক্যাটাগরিতে তিনি আলমডাঙ্গা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার অর্জন করেন। গত ৮ ও ৯ ডিসেম্বর জেলা যথাক্রমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ১৯৪৫ সালের ১৫ অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার শেরপুর গ্রামের সমভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলতাফ হোসেন ছিলেন জমিদার।
১৯৫৮ সালে আর দশজন অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের মেয়ের মত কহিনূর বেগমও আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নসাধ নিয়ে শিক্ষিত তরুণের সংসারে যান নববধূ হয়ে। শিক্ষিত ও ধর্মপ্রাণ স্বামী বজলুর রহমান ছিলেন হাই স্কুলের হেড মাস্টারও । একজন আদর্শ শিক্ষকের পরিবার যে কী পরিমাণ দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত তা সহজেই অনুমেয়। আবার সেই শিক্ষক যদি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হন তাহলে সেই দারিদ্রের কশাঘাত অবর্ণনীয় উঠে। কহিনূর বেগমের ৪ পুত্র সন্তানকেই সেই অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে যথার্থ শিক্ষিত করে গড়ে তুলে সমাজে স্বয়ং উদাহরণ হয়েছেন।
অক্টোপাসের মত দারিদ্র্রে ঘেরাটোপে অবস্থান করা সত্তে¡ও এই মহীয়সী নারী সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দুর্মর স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলেন। প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করেও নিজ সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর দু:স্বপ্ন দেখেছিলেন। দারিদ্রের ভ্রæকুটি উপেক্ষা করেই তিনি সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার এ স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন।
আমেরিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন, "আমি আমার মায়ের প্রার্থনা মনে করি এবং তারা সবসময় আমাকে অনুসরণ করে। ওরা সারাজীবন আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।"
আব্রাহাম লিঙ্কনের মত এই চার সন্তানও তাদের মায়ের হৃদয়কে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
মা বাবার অনিরুদ্ধ প্রেরণা আর শ্রমে ঘামে এক ছেলে হলেন ডাক্তার ও অন্য তিন ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে জননীকে আখ্যা দিলেন রতœগর্ভা।
১ম সন্তান মোঃ কুদরত-ই-নূর ১৯৭৭ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গার উপজেলার ঘোষবিলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ, ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ হতে এইচএসসি পাশ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে বোটানিতে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর পাংশা সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন ও ওই কলেজ হতে অবসর গ্রহণ করেছেন।
২য় সন্তান খালিদ আল-আজম উল্লেখিত স্কুল এবং কলেজ হতে ওই একই সালে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৮০ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তারপর এমবিবিএস পাশ করে বাংলাদেশ সরকারের ধর্মমন্ত্রণালেয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশনের মেডিকেল অফিসার ও মিশন প্রধান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে সবশেষে ঝালকাঠি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
৩য় সন্তান মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান উল্লেখিত স্কুল থেকে ১৯৮৫ সালে এসএসসি পাস করে ১৯৮৭ সালে আলমডাঙ্গা কলেজ হতে এইচএসসি পাস করার পরে ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৯৪ সালে। পরে বিশ্বের এক নম্বর এবং সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৯৬ সালে। ব্র্যাকে চাকরি করা কালীন ২০০৫ সালে ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে বদলি হন। সেখানে সাড়ে সাত বছর কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে দেশে ফিরে আসেন। বর্তমানে রাজশাহীতে কর্মরত আছেন।
৪র্থ সন্তান মোস্তফা মাহমুদ কবির উল্লিখিত স্কুল থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি এবং ১৯৯০ সালে আলমডাঙ্গা কলেজ হতে এইচএসসি পাশ করেন। তারপর ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালযয়ে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৯৭ সালে। তারপর নিজ এলাকায় আদর্শ মহাবিদ্যালয়ে তার শিক্ষকতা জীবন শুরু করে আজোবধি কর্মরত আছেন।
উল্লেখিত চারটি সন্তান একই সাথে শিক্ষিত করে মানুষ করার ক্ষেত্রে চরম দরিদ্রের কষাঘাতে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে এই মহীয়সী নারীকে।
স্বনামধন্য বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান স্মৃতিচারণ করে বলেন,"এক বেলা খেয়ে না খেয়ে আমাদের চার ভাইকে মানুষ করেছেন। ৪ সন্তানকে মানুষ করাই ছিল মহীয়সী জননীর একমাত্র ব্রত।স্বামীর শিক্ষকতা পেশার সামান্য ইনকাম দিয়ে সংসার চালানোই ছিল দায়। সেখানে ছেলেদের লেখাপড়া খরচের ভার বহন করা সত্যিই সত্যিই কষ্টসাধ্য ছিল। তাই হাঁস মুরগি পালন, ছাগল পালন, ও সবজি চাষ করে আমাদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন। ওনার আরো ইচ্ছা ছিল এই অজো পাড়াগাঁয়ে থেকে ছেলেগুলোকে মানুষ করে অন্যের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করা। আরো চেয়ে ছিলেন তার সবকটি ছেলেই যেন দেশের প্রয়োজনে কাজে লাগে।"
"আমার মা মনে করেন আমিই সেরা আর মা মনে করেন বলেই আমি সেরা হয়ে গড়ে উঠেছি।"
বিশ্বকাপ জয়ের পর বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলার দিয়াগো ম্যারাডোনা সাংবাদিকদের সাথে উক্ত কথা বলেছিলেন। দারিদ্রসহ সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মায়ের সুদৃঢ় মনোবলের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ৪ সন্তানই আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। উচ্চ শিক্ষা লাভের পর সমাজে নিজের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মায়ের প্রতি তাদের অবিচল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসারই বহি:প্রকাশ।