১৮ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলমডাঙ্গার প্রথম রাজনৈতিক হত্যা: দীর্ঘ এক যুগেও বল্টুর বিচার নিরবে নিভৃতে কাঁদছে

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
অক্টোবর ২৮, ২০২৪
100
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

এক যুগ পূর্বে ২০১২ সালের কথা। আব্দুল হাই বল্টু ছিলেন আলমডাঙ্গা পৌর যুবদলের আহ্বায়ক। নিবেদিতপ্রাণ জাতীয়তাবাদী শক্তির উপাসক। হাস্যোজ্জ্বল-প্রাণোচ্ছ্বল এক যুবক। সদানন্দ এই যুবকের রাজনৈতিক পরিচয়ের চে সামাজিক পরিচয় বড় হয়ে উঠেছিল। দলমত নির্বিশেষে সকলের সাথে অকৃত্রিম আন্তরিক সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করে নিয়েছিলেন। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথেও এক অভূতপূর্ব বন্ধন রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিএনপি নেতা টিলু উস্তাদকে সকলেই সমীহ করে কথা বললেও বল্টুর কথা ভিন্ন। তিনি টিলু উস্তাদের সাথে যেমন হাসি তামাসায় মেতে উঠতেন, তেমনি স্বাভাবিকতায় আওয়ামিলীগ নেতা প্রয়াত টিপু মোল্লার সাথেও। তার হাসি তামাসায় সকলেই বয়সের ভেদাভেদ ভুলে যেত। উতুঙ্গ হাসির ফোয়ারায় ভাসিয়ে দিতে পারতেন সকল রাজনৈতিক ভেদাভেদ।

এহেন বল্টুকে পরিকল্পিতভাবে তাড়িয়ে ধরে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালের ২৬ অক্টোবর কোরবানি ঈদের চাঁদরাতে এ নৃশংস হত্যাকাÐ ঘটানোর পর প্রধান ঘাতক টুটুলকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ ছেলুনের সহোদর চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার তৎকালীন মেয়র টোটন জোয়ার্দ্দার আলমডাঙ্গা উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার আজীবন সম্পাদকের পদ উপঢৌকন দেন। "বাঘ" নামে খ্যাত তৎকালীন আলমডাঙ্গা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দেলু পার্টি অফিসে ঘাতকচক্রকে অভিনন্দিত করেছিলেন। আজও বল্টু হত্যার বিচার পায়নি তার এতিম কন্যা, বিধবা স্ত্রী, তার বাপ-মা, ভাই- বোনসহ বিএনপির অগণিত নেতাকর্মী। এখনও বল্টু হত্যার বিচার স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট হাসিনার ধ্বজাধারী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে নিরবে নিভৃতে ডুকরে ডুকরে কাঁদে আদালত প্রাঙ্গণে।


আব্দুল হাই বেল্টু আলমডাঙ্গা পৌর শহরের মিয়াপাড়ার মরহুম আব্দুল বারীর ছেলে ছিলেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতির প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ ছিল তার। রাজনীতির প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্খার কাছে দারিদ্র হার মেনেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমজনতার নেতা। এ অতুল জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায়।
সে সময়টা ছিল আওয়ামী লীগের সবকিছু দখল ও আয়ত্বে নেওয়ার প্রতিযোগিতা। পাগলা ঘোড়ার মত সব শুভ, সব মঙ্গকর অর্জনগুলি দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে শেষ করে দেওয়ার আওয়ামী কে উন্মাদনার। লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে সবকিছু দখলের সীমাহীন কুৎসিত কদর্য প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় ঘাতকচক্রের সবচে বাঁধা মনে করেছিল বল্টুর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। তারা বল্টুকে পৃথিবীর আলোহাওয়া থেকে সরিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। সুযোগ খুঁজছিল বল্টুর প্রাণ সংহারের। এরই মাঝে কোরবানীর ঈদ উপস্থিত। সেদিন ছিল কোরবানির ঈদের চাঁদরাত। সবাই আত্মত্যাগের মহিমাময় ঈদ আনন্দের শেষ সময়ের আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। অনেকে শেষ মূহুর্তে বাকী কেনাকাটা সেরে নিতে ব্যস্ত।


শুধু দরিদ্র বল্টুর পকেটে কোন টাকা ছিল না। তার নিজের তো নয়ই, পরিবারের কারও জন্য কিছু কেনা হয়নি। চুপচাপ বসেছিলেন বিএনপি নেতা শেখ সাইফুল ইসলামের নিকট। এক পর্যায়ে সাইফুল ইসলাম তাকে কিছু টাকা দিলে একমাত্র শিশুকন্যার জন্য মেহেদি কনেন প্রথমেই। পরে বাকি টাকা দিয়ে সেমাই চিনি কেনেন। শুধু এইটুকু নিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন জনপ্রিয় যুবনেতা বল্টু।


রাত পোহালেই ঈদ। সকলে ঈদের শেষ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বল্টু বাড়ি ফেরার পথে হাটছেন। শিশুকন্যা তখনও জেগে। তার বাবার আসছেন যে লাল টুকটুকে মেহেদি নিয়ে। মেয়ের কথা মনে পড়তেই কোথাও দাঁড়ায়নি বল্টু। জোর কদমে বাড়ি ফিরছিলেন। আদরের শিশুকন্যা ঘুমিয়ে পড়ার আগেই ঘরে ফিরতে হবে তাকে। কিন্তু রাস্তা তো একেবারেই ফাঁকা। সবাই বাড়িতে ব্যস্ত সকালে ঈদ উদযাপনের জন্য। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে ঘাতকচক্র। তারা বল্টুর বাড়ি ফেরার পথে ওৎ পেতেছিল। পেছন দিক থেকে তাড়িয়ে ধরে কুপিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রেখে ঘাতকেরা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে চলে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় গলির রাস্তায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন বল্টু।


সন্ত্রাসী ঘাতকরা চলে যাওয়ার পর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে রাতেই কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পরে আব্দুল হাই বল্টুকে কে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়।
পরদিন শনিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।


আলমডাঙ্গা শহরে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ছিল এটি। সর্বজনপ্রিয় বল্টুর হত্যাকান্ডের সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের ঈদ আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। মুহুর্তে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে শহর। বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে বুকফাটা হাহাকার! ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতা শামসুজ্জামান দুদু জানাযায় ছুটে আসেন। এমনকি এ শোক ও বিয়োগগাঁথা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদেরও মর্মাহত করে। টিপু মোল্লাসহ অনেকেই শোক প্রকাশ করেন।


তবে আওয়ামীলীগের ছত্রছায়ায় সেই দলের অঙ্গসংগঠনের কতিপয় নেতাকর্মী বল্টুর মত নিষ্পাপ রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করেছে - এ কলঙ্কতিলক আলমডাঙ্গার আওয়ামী লীগের ভালে অমোচনীয়ভাবে লেপ্টে গেছে। ঘাতককে পুরষ্কৃত করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতার পরিবার থেকে। এই সর্বোচ্চ নেতার ধর্মছেলে দেলুবাঘ ঘাতকচক্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

স্বজনদের চোখের সামনে, সতীর্থ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সামনে গত এক যুগ প্রতিনিয়ত ঘাতকরা প্রশাসনের আস্কারায় ঘুরে বেড়িয়েছে। চোখ রাঙিয়েছে। কিন্তু কোন বিচার হয়নি। জেলার সর্বোচচ নেতার ঈশারায় পুলিশ র‌্যাব তাদের গ্রেফতারের পদক্ষেপ নেয়নি। নির্জনে নিরবে স্বজনেরা আক্ষেপ করেছে শুধু। সতীর্থরা ফেলেছেন অশ্রæ আর দ্রোহের আগুনে পুড়েছেন। শহিদুল কাউনাইন টিলু উস্তাদ ও শেখ সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে বাব বার আলমডাঙ্গা থানায় গিয়েও ফলোদয় হয়নি। খন্দকার জিহাদ ই জুলফিকার টুটুলসহ ১৫ জন আসামিকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়নি। সে সময় মামলাটি তদন্ত করছিলেন আলমডাঙ্গা থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) ফারুক হোসেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, " আই অ্যাম সরি!"


এখন, এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বল্টু হত্যার যথার্থ বিচারের কী হবে?


উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শহিদুল কাউনাইন টিলু জানান, মামলাটি নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ মদদে নানা কারসাজি করা হয়েছে। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আদালতের পিপি পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছি। খুব দ্রুত মামলার নথিপত্র আপডেট করে মামলাটি পুণরুজ্জীবিত করা হবে। ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram