২৮ অক্টোবর ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়

২৮ অক্টোবর ২০০৬। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি একটি কলংকিত দিন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর শুধু আমার জীবনে নয়, আমার মনে হয় অগণিত বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ একে গেছে। কারণ সেদিন যা ঘটেছে এবং যেভাবে ঘটেছে তা কখনো সভ্য মানুষের মন নিয়ে কল্পনা করা সম্ভব না। আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা আন্দোলন, ২৫- শের কালরাত্রি, চেঙ্গিসীয় বর্বরতাসহ বিশ্বব্যাপী নানান বর্বরতম ঘটনা ইতিহাস থেকে জেনেছি। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে সজ্ঞানে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে গণতান্ত্রিক কর্মসূচির ব্যানারে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার কর্মসূচি ইতিহাস থেকে কখনো খুঁজে পাইনি। শুধু তাই নয়, পিটিয়ে হত্যার পরে প্রতিহিংসা জিঘাংসা করার জন্য লাশের ওপর নৃত্য, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানবদেহের মৃত্যু নিশ্চিত করার মত ঘটনা রাজপথে প্রকাশ্যে দ্বিতীয়টি আর ঘটেনি।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দিনটি ছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন। এর আগের দিন ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের নিমিত্তে জোটভুক্ত সকল দল আলাদা আলাদা সমাবেশের আয়োজন করেছিল। বিএনপি নয়াপল্টনে তাদের অফিসের সামনে আর জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের আয়োজন করে। চারদলীয় জোট যখন সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন তার দলের ও জোটভুক্ত ১৪ দলের নেতাকর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে এক জনসভায় লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় অবরোধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। এরপরই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণের পর থেকেই সারাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াতের অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত। পুরো দেশব্যাপী চলে লগি-বৈঠার নৃশংস তান্ডবলীলা।
বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে জামায়াতের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ছিলো বিকাল ৩টায়। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জামায়াতের সমাবেশ স্থলের মঞ্চ ও পুরানা পল্টনে অবস্থিত জামায়াতের মহানগরী ও ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা চালানোর লক্ষ্যে পল্টন মোড়, পুরানা পল্টন মসজিদ গলিসহ চতুর্মুখ দিয়ে আক্রমণ করে। তাদের টার্গেট সভামঞ্চ গুঁড়িয়ে দেয়া এবং পূর্ব থেকেই কার্যালয়ে অবস্থান করা জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ওপর হামলা চালানো। তাদের সুপরিকল্পিত পৈশাচিক হামলায় ঝড়েপড়ে জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের তাজাপ্রাণ এবং মারাত্মক আহত হয় অসংখ্য মানুষ। সন্ত্রাসীরা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের লাশের উপরে উল্লাস নৃত্য করে সৃষ্টি করেছিল এদেশের ইতিহাসে এক হৃদয় বিদারক ইতিহাস। তাদের বর্বরতা সেদিন আদিম যুগের বর্বরতা ও নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছিল। সেদিনের পৈশাচিক হামলায় নিহত হয়েছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য হোসাইন মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম, সাথী গোলাম কিবরিয়া শিপন ও সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হাবিবুর রহমান, জসীম উদ্দীন, এবং হাজারেরও অধিক মানুষ আহত হয়।
প্রশ্ন হলো কি অপরাধে তাদের হত্যা ও আহত করা হলো? তাদের অপরাধ তারা ইসলামকে ভালোবাসতো। তারা এদেশে ইসলামী সমাজ কায়েম করতে চেয়েছিল। তারা মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিত। তারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলকে ভালোবাসতো এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলতো। তারা আধিপত্যবাদী শক্তির তাঁবেদারদের কবল থেকে এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুসলিম জাতিসত্তা ও ইসলামকে হেফাজত করার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলো। এ হত্যাকান্ড যারা ঘটিয়েছিলো তারা এদেশের স্বধীনতার সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ইসলামের চরম দুশমন। এ ঘটনার মাধ্যমে জাতির সামনে সেদিন পরিষ্কার হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর ১৪ দল ফ্যাসিবাদী শক্তি। তাদের হাতে এদেশের জনগণের জান-মাল,গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। সেদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত হামলা চালিয়ে তারা এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে গোটাজাতিকে আতংকিত করে দিয়েছিল।
২৮ অক্টোবরের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সুতরাং ২৮ অক্টোবরকে ‘লগি-বৈঠার তাÐব দিবস’ হিসাবে পালন করে আগামী প্রজন্মকে সতর্ক করে দিতে হবে। যারা এ ঘটনার নির্দেশ দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে, তাÐব চালিয়েছে তাদের সবাইকে দ্রæত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পুরো পৃথিবীর মানুষের সামনে এতগুলো মানবসন্তানকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করার বিচার যদি না হয় তাহলে কোন ঘটনার বিচার হবে! কার বিচার হবে! তাহলে বিচার বিভাগইবা কী জন্য! রাজনৈতিক ঘটনা বলে এই মামলাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে যা পৃথিবী বাসীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। খুনি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। অবশেষে শহীদ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে শেষ করছি। মহান আল্লাহ সকল শহীদদেরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।
আমিন।
লেখকঃ মোঃ আক্তারুজ্জামান
সভাপতি
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির আলমডাঙ্গা পৌর শাখা