১লা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অগ্নিসেনাখ্যাত অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন আর নেই

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
জুলাই ১, ২০২৪
309
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

অগ্নিসেনাখ্যাত অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দীন আর নেই( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ১ জুলাই বেলা পৌণে তিনটাই কালিদাসপুরের নিজ বাসভবনে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

গতকাল সন্ধ্যায় ৬টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস ও আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ গণি মিয়ার উপস্থিতিতে জেলা পুলিশের একটি চৌকস দল গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র সন্তানসহ অস্খ্যং গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাকে কালিদাসপুর গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, মঈনউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে থানায় ঢুকে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর কারণে স্থানীয়ভাবে তাকে ‘অগ্নিসেনা’ হিসেবে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। বেসরকারিভাবে ঢাকাতেও একাধিক সংস্থা তাকে সন্মাননা প্রদান করেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে শুরু হলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মঈনউদ্দিনের যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭০ সালে। সেদিনের স্কুলছাত্র মঈনউদ্দিনের দুঃসাহসী কর্মকান্ড গল্পকাহিনিকেও হার মানায়।

১৯৭০ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে শোক দিবস পালিত হচ্ছিল। কালো পতাকা উত্তোলন করা হয় বিভিন্ন স্থানে। সারাদেশে প্রতিবাদ শুরু হয়। পথে নামে ছাত্র-জনতাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা বহুমুখী বিদ্যালয় থেকেও একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। সেটি ৪ মে থেকে ৬ মে এর মধ্যে কোনো একদিন। মঈনউদ্দিন তখন মেট্রিক [এসএসসি] পরীক্ষার্থী ছিলেন। বিক্ষোভ মিছিলের সঙ্গে স্কুলের বাইরে বের হন মঈন উদ্দিন। রাস্তায় তখন অনেক মানুষ। দোকান বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা নেমে এসেছেন। তখন অনেকের হাতেই ছিল কালো পতাকা। তার হাতেও একটি কালো পতাকা ছিল। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তরে কালো পতাকা তোলা হচ্ছিল। সেদিন মিছিলের সঙ্গে তিনিও আলমডাঙ্গা থানা চত্বরে ঢুকে পড়েন। সেখানে উড়ছিল পাকিস্তানি পতাকা।

তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানি পতাকা অর্ধনমিত করে তার পাশে কালো পতাকা তুলে দিতে। একজন পুলিশ তাকে এ কাজে বাধা দেয়।
তারও জেদ চেপে যায়। মাথা গরম হয়ে যায়। তিনি পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেললেন।

এ জন্য তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। ২১ জুন রাত ২টায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ছয় মাস কারাগারে আটক থাকতে হয়েছিল। ১৮ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আছে অনেক ঘটনা; অনেক স্মৃতি রয়েছে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের করিমপুর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখান। পরে বেতাই ও আসামে যুদ্ধের ট্রেনিং নেন। বারাকপুরেও ছিলেন। সেখানে তোফায়েল আহমেদ ও নূরে আলম জিকুর অধীনে থেকেছেন।

ভারতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শেষ করে দেশে আসেন। কুষ্টিয়ার মিরপুরের মারফত আলীর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছিলেন।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, গরু চরানোর রাখাল সেজে হানাদার বাহিনীর অবস্থান জেনেছেন। গুপ্তচরবৃত্তি করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছেন।

“তারা আমাকে রাখাল ভেবে চড় মেরে ছেড়ে দেয়। আমি হানাদার বাহিনীর ডেরা থেকে ফিরে আসি গোপন তথ্য নিয়ে, তাদের অবস্থান ও প্রস্তুতি জেনে। এসব তথ্য পরে যুদ্ধে কাজে লেগেছিল।”।
পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর ঘটনায় দেশ স্বাধীন হলে তাঁকে ‘অগ্নিসেনা’ হিসেবে সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। আলমডাঙ্গা পৌরসভা ২০০৮ সালে আমাকে ‘অগ্নিসেনা’ হিসেবে সংবর্ধনা দেয়, স্বর্ণপদকও দেয়। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ও বেসরকারিভাবে ঢাকা থেকে ‘অগ্নিসেনা’ হিসেবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন।
“অগ্নিসেনা হিসেবে মঈনউদ্দিন বিভিন্নভাবে সংবর্ধিত হয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈনউদ্দিনের বাবার নাম গঞ্জের আলী। বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কালিদাসপুর গ্রামে। বাবার ছিল মুদি দোকানের ব্যবসা। ১৯৮৩ সালে বাবা মারা যান। সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।

তিনি শেষ বয়সে ফার্নিচারের ব্যবসা করতেন। কালিদাসপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু তিনি আর্থিক সহায়তা চান নি কখনও। তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর আগে তাকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অগ্নিসেনা’ উপাধি দেওয়া হয়।

গার্ড অব অনার শেষে জানাযা নামাজে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন,কালিসাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ শেখ আশাদুল হক মিকা, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. আব্দুর রশিদ মোল্লা, সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিউর রহমান জোয়ার্দ্দার সুলতান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা নওয়ার আলী নহর, বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সেলিম হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী মনিন্দ্রনাথ দত্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা মহি উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা রমজেত আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা খবির উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী মাস্টার, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ইয়াকুব আলী মাস্টার, উপজেলা আয়ামীলীগের সহসভাপতি আলহাজ¦ লিয়াকত আলী লিপু মোল্লা, বণিক সমিতির সভাপতি আরেফিন মিয়া মিলন, ক্যাশিয়ার আলাউদ্দিন, উপজেলা বিএনপি নেতা শেখ সাইফুল ইসলাম, উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আক্তার জোয়ার্দ্দার, পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজুল হক পিন্টু, সাধারন সম্পাদক জিল্লুর রহমান অল্টুসহ সকলদলের নেতাকর্মি, আত্মীয় স্বজন ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনায় সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন ছোট ছেলে আ ক ম রাসেল পারভেজ রাজু।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram