কয়েক বছরে মাদ্রাসা সংখ্যা কয়েক গুণ।। স্কুল ছেড়ে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে মাদ্রাসায়
রহমান মুকুল: মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মাদ্রাসা শিক্ষা অভুতপূর্ব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আলমডাঙ্গা উপজেলায় গত কয়েক বছরে চার/ পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে মাদ্রাসার সংখ্যা। স্কুল ছেড়ে শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছে মাদ্রাসায়। সবচে' বেশি যাচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।
সংখ্যায় অল্প হলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থিও মাদ্রাসায় চলে যাচ্ছে। সমাজের সচেতন মহলের অনেকেই এমন দাবি করেছেন।
তাদের অনেকে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অনেকে বলেছেন, জোর করে ডিমোটিভেট করে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না, সেটাও পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
তারা আরও বলেন, যারা মাদ্রাসা থেকে পাশ করে, তারা ওই গন্ডির ভেতরেই থাকে। বেহেস্তে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদেরকে মাদ্রাসায় নেওয়া হয়। কিন্তু বেহেস্তে যাওয়া এত সহজ নয়। বিষয়টি বোঝানোর জন্য শিক্ষক, অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ জানান।
এ অবস্থা শুধু আমাদের অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। কমবেশি সমগ্র দেশের। প্রাইমারি ছাত্রদের মাদ্রাসায় চলে যাওয়ার বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি গণস্বাক্ষরতা অভিযান নামক একটি এনজিও মোর্চা তাদের প্রকাশিত গবেষণায় বিষয়টি তুলে ধরেছে। ২০২০ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ এমপিওভুক্ত ও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রায় ২১ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে এবং এনজিও স্কুলে পড়ালেখা করে। আনুমানিক ৩ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় (কওমি, বেসরকারি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আলিয়া বা সরকারের সহায়তায় পরিচালিত মাদ্রাসা) পাঠাতে পছন্দ করেন। ৩ শতাংশের অধিক শিক্ষার্থী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় স্থানান্তরিত হয়েছে।
তারা গবেষণা করে দেখিয়েছে, ২০২০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদ্রাসায় স্থানান্তরের একটি লক্ষণীয় প্রবণতা দেখা গেছে। মাধ্যমিক স্তরের তুলনায় প্রাথমিক স্তরে এই প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি (৬.৪ শতাংশ) ছিল।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে গত চার বছরে ১০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী কমলেও এ সময়ে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে আড়াই লাখেরও বেশি।
আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি (অধুনালুপ্ত) রেফাউল হক বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কোন শিক্ষার্থি মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে, এমন তথ্য তার জানা নেই। তবে গত কয়েক বছরে উপজেলায় মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্বীকার করেন।
আলমডাঙ্গা উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষার অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার ইমরুল হক জানান, "এবতেদায়িসহ আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১২ টি এমপিওভূক্ত মাদ্রাসা রয়েছে। নন এমপিওভূক্ত আছে আরও ৪টি। তাছাড়া, বেসরকারিভাবে/ ব্যক্তিগত উদ্যোগে নূরানি, হাফেজি, কওমি ও ক্যাডেটস্কিম মাদ্রাসা রয়েছে প্রায় ৭০ টি বা তার বেশি। "
ওয়াকিবহাল সূত্রের দাবি -- এখন উপজেলায় কওমি, হাফিজিয়া, নূরানি ও ক্যাডেটস্কিম মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় শতাধিক। এর অধিকাংশ মাত্র কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে আলমডাঙ্গা পৌর এলাকায় মাদ্রাসা সংখ্যা ২৩ টি। তার মধ্যে মাত্র ৬ টি ব্যতিত বাকী সবগুলি তৈরি হয়েছে মাত্র বিগত কয়েক বছরে। এখন, পৌর শহরে ঘুরতে বের হলে নিত্য নতুন মাদ্রাসার দেখা মেলে।
দারুস সুন্নাহ একাডেমী, দারুল ইসলাম নুরানী মাদরাসা, মাদরাসাতুত তাকওয়া, কারিমিয়া মাদরাসা, মারকাযুল কুরআন মাদরাসা, আলমডাঙ্গা মহিলা মাদরাসা, মারকাযুত তাহফিয মাদরাসা, দারুল আরকাম আল-ইসলামিয়া আলহেরা মডেল হাফিজিয়া মাদরাসা ইত্যাদি চিত্তাকর্ষক নামের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক তার শিশু সন্তানকে মাদ্রাসায় দিয়েছেন। সখানে কোরআন মুখস্ত শিখছে। তিনি জানান, "নৈতিক শিক্ষা না পেলে সন্তান কখনও প্রকৃত মানুষ হবে না। তাই ছোট বেলায় সবচে আগে তার নৈতিক বা ধর্মীয় শিক্ষার স্ট্রং বেজ দরকার। সেকারণে কোরআান শিখতে দিয়েছি।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলমডাঙ্গা কালিদাসপুরের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের দুটি সন্তানই মাদ্রাসায় পড়ে। ওই শিক্ষকের পরিবারও বেশ সচ্ছল। কেন তিনি সন্তানদেরকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছেন জিজ্ঞেস করলে জানান, " মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহ তায়ালার উপাসনার জন্য। সেই উপাসনার কাজটা যাতে সন্তান ভালোভাবে শিখতে ও অভ্যস্থ হতে পারে, সেই জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে প্রায়োরিটি দিয়েছি। তাছাড়া, পৃথিবীতে একটা ভালো, আল্লাহর প্রতি ও সমাজের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ সন্তান রেখে যেতে চায়। জেনারেল লাইনে আমরা পড়াচ্ছি। কিন্তু শিক্ষার্থিরা প্রকৃত মানুষ তৈরি হচ্ছে না। তারা কেউ ঘুষখোর ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কেউবা দুর্নীতিবাজ অফিসার হচ্ছে।"
গোবিন্দপুর গ্রামের নাইমুর রহমান (ছদ্ম নাম) আলমডাঙ্গা সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তো। কয়েক মাস পূর্বে সে এক হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। তার পরিবারের বক্তব্য হচ্ছে, "এই পাড়ার পরিবেশ ভালো না। নাইমুর পাড়ার বাজে ছেলেদের সাথে খেলে। তাদের সাথে ফ্রি ফায়ার খেলে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। রাগি স্বভাবের হয়ে উঠছিল। চারদিকে নেশা দ্রব্যের ছড়াছড়ি। এসব চিন্তা করে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছি। এখন সে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।"
আবু হাসান মুন্সি পেশায় প্রকৌশলী। মেধাবি ছাত্র হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। এলাকায় শিক্ষা নিয়ে তিনিও কাজ করছেন।
মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহ বৃদ্ধির কারণ বলতে গিয়ে তিনি জানান,বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বেড়ে যাবার কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমত, মুসলিম প্রধান দেশে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক প্রাথমিক থেকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। যেটা একটা বড় কারন। অভিভাবকদের অনেকে চিন্তা করছে, মাদ্রাসায় পড়ালে তার সন্তান মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ নিয়ে বড় হবে। ফলে সমাজের নৈতিক অবক্ষয় কমে যাবে ।
দ্বিতীয়ত, মাদ্রাসা শিক্ষাতে কম খরচে ক্লাসের পড়া, হাতের লিখা ক্লাসেই গুরুত্ব সহকারে করানো হয় এবং আবাসিক সুবিধা দেওয়া হয়। সেই জন্য অনেক অভিভাবক বাচ্চাদেরকে মাদ্রাসাতে ভর্তি করছে ।"
আনন্দধাম মসজিদের খতিব মাওলানা ও নিমগ্ন পাঠাগারের উদ্যোক্তা ইমদাদুল হক জানান, "গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপকতা ও সহজলভ্যতার কারণে ইসলাম জানারও সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজের জন্য এবং সন্তানসন্ততিসহ পরিবারের সকলের জন্য ইসলাম জানার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, তাই সন্তানকে মাদরাসায় পড়ানোর দিকে ঝুঁকছেন।
তাছাড়া, বেশকিছু ইসলামি আইডল ব্যক্তিত্ব তৈরি হওয়া এবং জনসাধারণের কাছে পরিচিতি পাওয়াও কারণ। অনেক অভিভাবক ভাবছেন তাদের সন্তান ওই রকম সর্বজন পরিচিত ও বিখ্যাত আলেম হবে। সে জন্য তারা সন্তানকে মাদরাসায় দিচ্ছেন। এছাড়া, বিভিন্ন কারণে জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা হারানো। ইদানীং অধিকহারে কিশোর-তরুণদের বখে যাওয়া, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, মাদকাসক্ত হওযা ইত্যাদি। অভিভাবকরা ভাবছেন, ধর্মীয় শিক্ষা দিলে হয়তো সন্তান নষ্ট হবে না। তাই তারা সন্তানকে মাদরাসায় দিচ্ছেন।
এছাড়াও, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তির বৈশ্বিক কারণও উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, নানা কারণে মুসলিম জনসাধারণ ভাবতে বাধ্য হচ্ছে যে, সারাবিশ্ব জুড়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। পরিবারের সব থেকে উদাসীন ছেলে, যে কখনও পরিবারের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবে না, সেও যখন দেখে যে, তার পরিবার অন্যের দ্বারা আক্রান্ত ও নির্যাতিত, সেও তখন সাধ্যমতো পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নানা কারণে মুসলিম সর্বসাধারণের মাঝে এই চেতনা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ভেতরে নুন্যতম ঈমানি চেতনা আছে সেও চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে, ইসলামের জন্য তারও কিছু করার আছে। আমি কিছু করতে না পারলেও আমার সন্তানকে আমি ইসলামের খাদেম বানাব। এমন পরিস্থিতির কারণেও মাদ্রাসা শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে।