আলমডার বইমেলা: সবার চেতনায় স্পন্দিত হোক বইমেলার উদ্দেশ্য
রহমান মুকুল: যুগ সঞ্চিত জমাট অন্ধকার সরিয়ে আলমডাঙ্গার মত মফস্বলেও বইমেলা দ্যুতি ছড়ালো। শিশু, কিশোর, তরুণ তরুণীর পদভারে মুখরিত মেলাপ্রাঙ্গণ। বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে আমাদের দেশের মানুষ বহু ধারায় বিভক্ত। ডানপন্থী - বামপন্থী, স্বাধীনতার পক্ষ, বিপক্ষ, প্রগতিশীল -প্রতিক্রিয়াশীল। অবস্থা এমন হয়েছে যে, জাতীয় ইস্যুতেও আমাদের ঐক্যমত হওয়ার আশা নিতান্তই দুরাশা। এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র সাহিত্য চর্চা (বইপড়া) পারে মালার মত আমাদের সকলকে একই সূতায় গন্থিত করতে। কারণ, বই পড়া বা সাহিত্য সকলের হৃদয়কে একই সুতোয় বাঁধতে পারে।
সেকারণে আমাদের প্রয়োজন সাহিত্যের পাঠক সৃষ্টি করা। সাহিত্যরসিক সৃষ্টি করা। ন্যূন্যত, পাঠমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তোলা। তার মোক্ষম সুযোগ হতে পারে বইমেলা। প্রতিটি মফস্বলে বইমেলা ছড়িয়ে দেয়া দরকার।
ছোট ছোট শিশুরাও মা-বাবার হাত ধরে ছুটে আসছে বইমেলায় আবেগ-উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে। একদিকে আনন্দ রাশি রাশি, অনিন্দ্য বিনোদন, অন্যদিকে বইপড়ার মাধ্যমে চিত্তবিকশিত হওয়ার অপার সুযোগ সৃষ্টি হয় এই মেলা থেকে। বইমেলাকে অনেকেই প্রাণের মেলা বলে অভিহিত করে থাকেন। এখানে নবীন-প্রবীণ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অপূর্ব মিলনমেলার সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির অকৃত্রিম মেলবন্ধন। জাতি খুঁজে পায় তার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয়, শেকড়ের সন্ধ্যান। জানতে পায় জাতিসত্তার ক্রমবিকাশ ও ইতিবৃত্তের ধারা। এভাবেই উন্মোচিত হয় জ্ঞান রাজ্যের দশদিগন্ত।
বইমেলাকে কেন্দ্র করে আলমডাঙ্গা মফস্বলেও যেন নক্ষত্রের মেলা বসে। এখানে "উদ্ভাস" "সাহিত্য পরিষদ"সহ বেশ কয়েকটি স্টল আলো করে চাঁদের হাট বসতে দেখা যায়। সাহিত্যিক আনোয়ারুল ইসলাম সাগর, কবি অধ্যাপক আসিফ রহিম জোয়ার্দ্দার, আলোচিত সাহিত্যিক পিন্টু রহমান, ( পিন্টু রহমানের এবারের বই মেলার " তুলসীমাটি" গল্পগ্রন্থটি গল্পকার পুরস্কারে পুরষ্কৃত হয়েছে), অধ্যাপক নওরোজ মোহাম্মদ সাঈদ, সাহিত্যিক আতিকুর রহমান ফরায়েজী, লিটল ম্যাগ " দর্পণ" সম্পাদক মোস্তাফিজ ফরায়েজীসহ অনেক কৃতিজনের সহাবস্থান দৃষ্টিকে প্রসন্ন করছে। বইমেলায় এলাকার আলোকিত মানুষগুলোর একত্র সন্নিবেশ যতটা নিবিড়ভাবে ঘটে থাকে, অন্য কোনো সমাবেশে সাধারণত তা ঘটে না। পাশাপাশি বই মেলার বিভিন্ন স্টলে শোভা পায় অসংখ্য গ্রন্থরাজি। এক একটা বই যেন নতুন ভাবনা, নতুন চেতনা রাজ্যের অর্গল খেলে দেয়। এক একটা বই যেন একেকটা আলোকিত পৃথিবীর প্রশস্ত জানালা। অতএব, বইমেলা হচ্ছে আলোকিত মানুষ এবং আলোকিত গ্রন্থরাজির যুগলসম্মিলন। এ এক অনন্য মিথক্রিয়া। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার জন্য আত্মোত্সর্গ করার মাস। এই পৃথিবীতে আমরাই স্বতন্ত্র জাতি যাঁরা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত অকাতরে ঢেলে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।
পলাশ, শিমুল, অশোক, কিংশুকে প্রতিবছর সেই চেতনার আগুন শোভিত হয়ে আসে।
আমরা দৃঢ়চিত্তে এ প্রত্যাশা যাপন করতে চাই -- আগামিতে আলমডাঙ্গায় বসন্তদিনের বইমেলার আয়োজন সফল, সার্থক এবং সর্বাঙ্গসুন্দর হবে।
আরেকটি কথা বলা দরকার। নতুন করে আলমডাঙ্গায় বইমেলার প্রবর্তক এককভাবে আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজ, কলেজের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ ড. জেড এম আব্দুর রকীব।
তিনিই মূলত পুণর্জীবিত এ বইমেলার নিউক্লিয়াস। তাঁর কল্যাণকর একগুঁয়েমীতেই এ বইমেলার জন্ম হয়েছে। প্রসববেদনাটুকুও সঙ্গতভাবে সর্বংসহার মত সইবেন একা তিনিই।
গত শতাব্দীর সবচে প্রভাবশালী দার্শনিক ও গণিতবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, "একজন সাহসী পুরুষই একটা সুন্দর সমাজ গড়তে পারেন।"
অধ্যক্ষ ড. জেড এম আব্দুর রকীব এই বইমেলার, এই আলোকিত সভ্যতা সৃষ্টির পিলসুজ প্রজ্জ্বলের অন্তরালে তাঁর নির্জন স্বাক্ষর রাখলেন।