কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা অন্যতম সংবিধান রচয়িতা ব্যারিস্টার বাদল রশীদের স্মরণসভা
বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ও অন্যতম সংবিধান রচয়িতা ব্যারিস্টার বাদল রশীদের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ব্যারিস্টার বাদল রশীদের বাস্তুভিটায় উপজেলার রামদিয়া গ্রামে গতকাল রবিবার বিকেলে রামদিয়া-কায়েতপাড়া গ্রামবাসী ও খাসকররা ইউনিয়ন কৃষকলীগ যৌথভাবে এ স্মরণসভার আয়োজন করে।
স্মরনসভার প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম পানু। এসময় তিনি বলেন, প্রয়াত ব্যারিস্টার বাদল রশীদ শুধু বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠাতা না। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠণ করতে অসামান্য অবদান রাখেন। এই মহান নেতাকে সন্মান না দেখালে আমরা নিজেরাই ছোট হয়ে যাব। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অকৃতজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত হব।
খাসকররা ইউনিয়ন কৃষকলীগের সভাপতি আব্দুল মান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা কৃষকলীগের সভাপতি এমএ আজিজুল হক, ৭০“র অগ্নিসেনা বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন পারভেজ, উপজেলা কৃষকলীগের সাধারন সম্পাদক খন্দকার বজলুল করীম, উপজেলা কৃষকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিবার রহমান, পৌর কৃষকলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সৌমেন্দ্রনাথ সাহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইছাহক আলী মাস্টার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিন, উপজেলা কৃষকলীগের সহসভাপতি আবুল কাশেম, পৌর কৃষকলীগের সাধারন সম্পাদক সাহাবুল হক। খাসকররা ইউনিয়ন কৃষকলীগের সাধারন সম্পাদক হাফিজুর রহমানের উপস্থাপনায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, উপজেলা কৃষকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অভি মুন্নু কুন্ডু, দপ্তর সম্পাদক ফজলুর রহমান, পৌর কৃষকলীগের সহসভাপতি আরজেদ আলী, খাঁন আব্দুল মোতালেব,কুমারী ইউনিয়ন কৃষকলীগের সভাপতি রজব আলী, সাধারন সম্পাদক জহুরুল ইসলাম,বাড়াদি সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন, নাগদাহ সভাপতি আবু ইউনুচ, সম্পাদক আব্দুল বারেক, জাহিদ হাসান তিতু, আব্দুল হালিম প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ আলমডাঙ্গা উপজেলার প্রত্যন্ত রামদিয়া গ্রামে ১৯২৯ সালের এই দিনে সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন। পিতা রুস্তম আলী বিশ্বাস ছিলেন তৎকালীন কলকাতা শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ি। বাদল রশীদ ১৯৫২ সালে লন্ডন গমণ করেন বার-এ্যাট-ল পড়তে। ১৯৬৩ সালে তিনি লন্ডনের লিংকস ইন কলেজ থেকে বার-এ্যাট-ল পাস করেন। এ সময় থেকেই তিনি তাঁর সহজাত নেতৃত্বদানের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। লন্ডনে তিনি কলেজে পড়ুয়া বিভিন্ন দেশের সতীর্থদের নিয়ে গঠণ করেন “ব্যাক টু দ্যা ভিলেজ” নামের সংগঠণ।সাম্রাজ্যবাদের স্বর্গভূমি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে তরুণ বয়সেই তিনি যে আদর্শের মন্ত্রবীজ অস্তিত্বে ধারণ করেছিলেন, শেষ বয়সে গ্রামে বসবাসের মধ্যদিয়ে তার বহি:প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
১৯৬১/৬২ সালের ঘটনা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিন্ড মার্শাল আয়ুব খান লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। লন্ডনস্থ পাকিস্তান দুতাবাস ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক। নির্ধারিত সময়ে ঘটল এক অঘটন। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির চেয়ারে এক বাঙ্গালী ছাত্র হঠাৎ এসে বসে পড়েন। এতে প্রচন্ড অপমানিত হন আয়ুব খান। অথচ নাটকীয়ভাবে এঘটনার মধ্যদিয়ে নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্র উন্মোচিত হয় ব্যারিস্টার বাদল রশীদের সামনে। তিনি সহজেই “হিরো ইমেজ” গড়ে তুলতে সমর্থ হন। অল্প সময়েই দেশে- বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ খবর। বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের কানেও এ তথ্য পৌঁছে যেতে সময় লাগেনি। তিনি তরুণ বাঙালী সমাজের সেনসেশন ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে ডেকে নেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। এরপর ১৯৬৩ সালে ব্যারিস্টারি পাস করার পরে দেশে ফিরলে তিনি ওই ঘটনায় আটক হন। প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান তাঁকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠান। ১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তারপর আসে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা ‘৭১ সাল। সে সময়ে প্রবাসী সরকারের তিনি ছিলেন পলিটিক্যাল লিয়াজো অফিসার ও প্রবাসী সরকার প্রধান তাজ উদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারি। তাঁর অফিস ছিল কলিকাতা ৫১ নম্বর প্রিন্সেস স্ট্রীট।
মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে তার ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠণ করতে অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি অল ইন্ডিয়া ডক ইয়ার্ড শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি কুলকি নায়ারের মাধ্যমে আমেরিকার ডক ইযার্ড শ্রমিকদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, কীভাবে আমেরিকা থেকে যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে গিয়ে পাকিস্তান মানবতা বিরোধী হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমেরিকার ডক ইয়ার্ড শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে তৎকালীন আমেরিকান সরকার নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েন। সেকারণে আমেরিকা বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধের সহযোগিতা করতে পাকিস্তানে সপ্তম নৌবহর পাঠাতে পারেনি। সপ্তম নৌবহর এসে পৌঁছলে মুক্তিযুদ্ধের কত বেশি ক্ষতি হত তা সহজেই অনুমেয়।
তিনি লন্ডন শহরে অবস্থিত তার একমাত্র বাড়িটিও জনমত গঠণের কাজে ব্যবহার করতেন। তাঁর লন্ডনের “বাংলাদেশ হাউজ” নামের বাড়িটি প্রবাসী সরকারকে দান করেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ওই বাংলাদেশ হাউজটি বাংলাদেশ দুতাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তিতে বাড়িটি “পুরাতন হয়ে গেছে” এই অজুহাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। মরহুম সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রি থাকাকালে বাড়িটি বিক্রি করা হয়।
সাংস্কৃতিক দূত : মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠণ ছাড়াও তিনি প্রবাসী সরকারের আর্থিক তহবিল গঠণে নামেন।
তিনি “বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ” নামে সাংস্কৃতিক সংগঠণ গড়ে তুলে মুম্বাইসহ ভারতের সকল বড় বড় শহরে অনুষ্ঠান করেন। তৎকালীন শান্তিনিকেতনের উপাচার্য’র সহযোগিতায় আপেল মাহমুদ, আব্দুল জব্বার, সরদার আলাউদ্দিন. নমিতা ঘোষ, মকছেদ আলী শাহসহ ভারতের নামিদামী বাঙ্গালী শিল্পীদের নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার বাদল রশীদের অনস্বীকার্য অবদান। অবদানের কথা প্রায় সকলের অজানা অধ্যায়। প্রবাসী সরকারের প্রধান তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রি ইন্দিরা গান্ধীর নিকট যখন বার বার ধর্ণা দিয়েও বাংলাদেশের স্বীকৃতি নিতে পারছিলেন না। তখন ব্যারিস্টার বাদল রশীদ দিল্লীর জামে মসজিদের প্রধান ঈমাম সাহেবকে বুঝিয়ে তাকে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিকট সুপারিশ করান। তার সুপারিশে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন ইন্দিরা গান্ধী।
কৃষকলীগ প্রতিষ্ঠাঃ কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু বাদল রশীদ অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯৭২ সালে আজকের দিনে বাংলাদেশ কৃষকলীগের প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু প্রতিষ্ঠাই করেন নি, কৃষকলীগকে সাংগঠণিকভাবে প্রতিষ্ঠার কাজও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্পন্ন করেছিলেন। কৃষকদের জন্য তিনিই দেশে প্রথম স্বতন্ত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেন। আজীবন কৃষকদের স্বজন হয়ে তাদের সাথেই তাঁর ছিল যাপিত জীবন।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৩ সালের ২৩ জুন মৃত্যুবরণ করেন।