আলমডাঙ্গা শহরে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার
আলমডাঙ্গা শহরে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শনিবার ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল ১১ টার দিকে আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার পুরাতন বাজারের নিজ বসতবাড়ি থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার রাতের যে কোন সময় তাদেরকে ঘরে ঢুকে নৃশংশভাবে হত্যা করেছে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা। নিহতেরা হলেন স্টক মালের ব্যবসায়ী নজির উদ্দির (৭০) ও তার স্ত্রী ফরিদা খাতুন (৬০)। শহরের ব্যস্ততম সড়কের পাশের ঘরে এভাবে বয়স্ক দম্পতি হত্যার রহস্য নিয়ে শহরে নানামুখি আলোচনা হচ্ছে।
জানা যায়, নজির উদ্দীন ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার ধুলিয়া গ্রামের ছেলে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তিনি আলমডাঙ্গা শহরে আসেন জীবিকার জন্য। এক সময় দারিদ্রের সাথে লড়াই করা মানুষ স্বপ্ন দেখতেন ধনাঢ্য হওয়ার। আলমডাঙ্গা শহরে আসার এক পর্যায়ে শহরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শীব নারায়ন ভৌতিকার সাথে হৃদতা গড়ে তোলেন। বনে যান এ ধনাঢ্য অবাঙ্গালীর পোষ্যপুত্রে। এরি এক পর্যায়ে তিনি শীব নারায়ন ভৌতিকার শহরের মূল্যবান জমি জাল করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। শীব নারায়ন ভৌতিকার প্রায় ৭০/৮০ কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে সরকারের সাথে মামলা চলছে। পরবর্তীতে নজির উদ্দীন, অসীত কুমারসহ অনেকেই সে জমি লীজ গ্রহণ করে নিজের দখলে রেখেছেন। নজির উদ্দীন এক সময় শিলা সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত করেন।
যে বাড়িতে এ দম্পত্তি খুন হয়েছেন, সে বাড়িটি ছিল প্রাক্তণ সেটেলমেন্ট অফিস ভবন। তিনি এ পোড়ো বাড়ি দখল করে লিজ নিয়েছেন। ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ী হয়েও ব্যবহার অনুপযোগী এ বাড়িতেই তিনি সস্ত্রীক বসবাস করতেন।
এসব কারণে তার চরিত্রের নেতিবাচক দিকটি বেশি আলোচিত হতো। জমিজমা সংক্রান্ত তাকে অনেকগুলি মামলা সামলাতে হতো।
আলমডাঙ্গা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম জানান, শুক্রবার রাত থেকে নিহত দম্পতির জামাই অহিদুজ্জামান লিন্টুসহ পরিবারের সদস্যরা তাদের ফোন করে না পেয়ে বাড়িতে এসে তালাবদ্ধ দেখতে পান। পরে আমাদের জানালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা তালা ভেঙে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করেন। তিনি আরও বলেন, গোসলখানা থেকে বৃদ্ধের হাত বাঁধা ও ঘরের মধ্যে থেকে বৃদ্ধার রক্তাক্ত মরদেহ পাওয়া যায়। বৃদ্ধার পাশে পড়ে ছিল ছোট কাঁচি। ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত করা হয়েছে বলে মনে। সিআইডিকে খবর দেওয়ার পর তারাও এসেছে। ময়না তদন্তের পর দ্রæত হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হবে হলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শিরা জানান, নিহত ফরিদা খাতুন বেগমের শ্বাসস্নালী ধারাল অস্ত্রে কেটে ফেলা হয়েছে । নিহত নজিরের গলায় ও বুকে ৬টি ক্ষত ছিল। তাদের দুজনারই হাত-পা বাঁধা ছিল।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে এত ব্যস্ত সড়কে অবস্থিত ঘরে ঢুকে দম্পতি হত্যাকান্ড নিয়ে সকলের মাঝে ঔৎসুক্য ছিল। পার্শ্ববর্তি ভূষিমালের দোকানের সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেযে দেখা গেছে যে, রাত ১১ টার পরে শ্রমিক শ্রেণির একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি দৌঁড়ে সড়ক দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তার পেছন পেছন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা ৫ জন উঠতি বয়সি তরুণ চলে গেছেন।
এ নৃসংশ হত্যাকান্ড ঘিরে এলাকাবাসির মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের মনে ৪টি সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
প্রথমত, নিহত নজীর উদ্দীন ব্যবসা করতেন নগদ টাকায়। তিনি সহজে ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। সম্প্রতি তিনি প্রায় ৪০ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছেন। সেই টাকা ঘরেই রেখেছেন। এমন বদ্ধমুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কোন চক্র চুরি কিংবা ডাকাতি করতে গিয়ে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করতে পারেন। কিন্তু নিহত ফরিদা খাতুন বেগমের হাতের সোনার বালা খুলে না নেওয়ায় এ সন্দেহ অনেকে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, নিহত নজির উদ্দীন এক সময় শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী স্বর্গীয় শীব নারায়ণ ভৌতিকার পোষ্যপুত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শীব নারায়নের অপার স্নেহ লাভের পর নিহত নজির উদ্দীন তার মূল্যবান সম্পত্তি জাল দলিল করে নেন। ক্ষুদ্ধ শীব নারায়ণ নজিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সে মামলা চলমান। পরবর্তিতে নজির উদ্দিন ও তার প্রতিবেশি ব্যবসায়ী অসীত কুমারসহ বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ শীব নারায়নের সাথে সরকারের যে জমি নিয়ে মামলা চলমান সেই জমি লিজ নিয়েছেন। নজির উদ্দীন, অসীত কুমারসহ বেশ কিছু ব্যক্তি শহরের মূল্যবান জমি নিজের দখলে নিতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের অন্তদ্বন্দ্বের কারণে এ হত্যাকান্ড ঘটতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
তৃতীয়ত, শীব নারায়ণ ভৌতিকার সাথে জমি নিয়ে নজির-অসীত সিন্ডিকেটের দীর্ঘদিনের বিরোধ। এই সিন্ডিকেটের ভেতর নজির উদ্দীনের বয়স সবচে বেশি। সত্তরোর্দ্ধ। ইদানিং প্রচন্ড অসুস্থও। তাই নজির উদ্দীনকে হত্যা করে সহজেই স্বর্গীয় শীব নারায়ণ ভৌতিকার একমাত্র ছেলের উপর চাপানো গেলে তিনি আর ভারত থেকে দেশে ফিরতে পারবেন না। ফলে সহজেই মোটা অংকের টাকার সম্পত্তি নির্বিঘ্নে ভোগদখল করতে পারবেন সিন্ডিকেটটি। এ সন্দেহ পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
চতুর্থত, নিহত নজির উদ্দীনের একমাত্র বেকার জামাইও সন্দেহের বাইরে নয়। নানা মুখে আলোচনা শোনা যায়।
চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ করছে পুলিশের একাধিক টিম। তবে, হত্যাকান্ডের কারণ প্রাথমিকভাবে এখনও জানা যায়নি। তাদেরকে হত্যা করে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। নজির উদ্দিনকে শৌচাগারের ভিতর হাত,পা বেঁধে ও তার স্ত্রীকে ঘরের মেঝেতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করা হয়েছে। রহস্য উন্মোচনে পিবিআই ও সিআইডি টিমও কাজ করছে।
ঘটনাস্থলে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(প্রশাসন ও অর্থ) আবু তারেক, আলমডাঙ্গা থানা পুলিশের, ডিবি, পিবিআই, সিআইডি, র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।