আত্মহত্যা প্রতিরোধে ইসলাম
মাওলানা ইমদাদুল হক
২০০৩ সাল থেকে ১০ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালন করা হচ্ছে। এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্যে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করা। আন্তর্জাতিকভাবে একটি দিবস প্রচলন থেকেই বোঝা যায়, মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কত আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যানও এর ভয়াবহতার কথাই জানাচ্ছে।
২০১৪ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। এছাড়া এর প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
গবেষকদের মতে পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা-প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় ও মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বেশকিছু কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে।
গবেষকদের সাথে পরিপূর্ণ একমত হয়েও আমরা বলতে পারি, আত্মহত্যার এ সকল কারণের উৎস মূলত স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির আত্মার সম্পর্কহীনতা ও পরকাল বিস্মৃতি। কেননা মানুষের আত্মা এসেছে মহান আল্লাহর কাছ থেকে। ইরশাদ হয়েছে, তারা আপনাকে আত্মা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বলুন, আত্মা আমার প্রতিপালকের নির্দেশ (সূরা ইসরা, আয়াত: ৮৫)। আর এই আত্মার প্রশান্তিও আল্লাহর স্মরণে। মহান আল্লাহ বলেন, শুনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই রয়েছে আত্মার প্রশান্তি (সূরা রাদ, আয়াত: ২৮)।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি ও তাঁর স্মরণের জন্য কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত ইবাদত পালন করতে হবে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিয়মিত সালাত আদায় করা এবং সালাতকে আল্লাহর সাথে মুনাজাতে পরিণত করা। মহান আল্লাহ বলেন, আমার ইবাদত করো এবং আমার স্মরণের জন্য সালাত আদায় করো (সূরা তাহা, আয়াত: ১৪)।
মানুষকে সমাজের মধ্যে বাস করতে হয়। স্বভাবতই সারাদিনের কর্মময় জীবনে বিভিন্নমুখী আবেগ, ভালোবাসা, ঘৃণা, হিংসা, রাগ, বিরাগ, ভয়, লোভ ইত্যাদির মধ্যে পড়তে হয়। এগুলো মানব-হৃদয়কে ভারাক্রান্ত, অসুস্থ ও কলুষিত করে তোলে। শুধু মাঝে মাঝে আল্লাহর স্মরণ, তাঁর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে নিজের আবেগ, বেদনা ও আকুতি পেশ করার মাধ্যমেই মানুষ এ ভয়ানক ভার থেকে নিজের হৃদয়কে মুক্ত করতে পারে । (সালাত : আল্লাহর সাথে বান্দার মুনাজাত,পৃষ্ঠা: ৭২)।
সালাতকে যিকির ও মুনাজাতে পরিণত করতে পারলে আমাদের মনোদৈহিক কোনো চাহিদা অপূর্ণ থাকবে না। জীবন হবে আনন্দময় ও উপভোগ্য। জীবনের প্রতি কখনোই এমন বিতৃষ্ণা ও বীতস্পৃহা জাগবে না যে, জীবন থেকে পালানোর জন্য নেশা ও আত্মহত্যার শরণ নিতে হবে। এমন বিশ্বাসীর আখিরাতের মনোমুগ্ধকর জীবনের প্রতি আগ্রহ যতই তীব্র, গভীর ও প্রগাঢ় হোক না কেন সে কখানোই দুনিয়ার জীবন থেকে পালানোর পথ খুঁজবে না। উভয় জীবন হবে তার উপভোগ্য ও আনন্দময়। ঈমান ও সালাতের এই আশ্রয় ছাড়া সমগ্র জীবনকে রাঙানোর আর কোনো বিকল্প নেই— আখিরাত তো নয়ই; না, দুনিয়ার জীবনের জন্যও নয়। (সালাত : আল্লাহর সাথে বান্দার মুনাজাত,পৃষ্ঠা: ৮)।
তাছাড়া যে মুমিনের আখিরাতের জীবনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে এবং ওহির সংবাদের ভিত্তিতে সে এই বিশ্বাসও রাখে যে, দুনিয়াতে আমার সকল অপ্রাপ্তি, সকল আঘাত, বেদনা, দুঃখ-কষ্টের জন্য আখিরাতে আল্লাহর দরবারে রয়েছে মহা পুরস্কার ও প্রতিদান তার অন্তরে কোনো হতাশা ও ভারবোধ জাগ্রত হয় না। যেমনটা আমরা দুনিয়ার ক্ষেত্রেও দেখে থাকি। মানুষ বড় কিছু পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্র অপ্রাপ্তি ও ছোটখাটো অনেক দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে সয়ে নেয়।
হাদীস শরীফে এসেছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার দেহে ফুটে, এ সবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন (সহীহ বুখার, হাদীস- ৫৬৪১ ও ৫৬৪২)।
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিপদে পতিত (ধৈর্যধারী) মানুষদের কিয়ামত দিবসে যখন প্রতিদান দেয়া হবে, তখন (পৃথিবীতে) বিপদমুক্ত মানুষেরা আকাঙক্ষা (পরিতাপ) করবে, হায়! দুনিয়াতে যদি কাঁচি দ্বারা তাদের শরীরের চামড়া কেটে টুকরা টুকরা করে দেওয়া হত (সুনান তিরমিযি,হাদীস- ২৪০২)।
হাদীসে কুদসিতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, আমি যখন আমার মুমিন বান্দার দুনিয়ার কোনো প্রিয়বস্তু উঠিয়ে নিই আর সে ধৈর্য ধারণ করে আমার কাছে প্রতিদান আশা করে আমার কাছে তার প্রতিদান জান্নাত (সহীহ বুখারি, হাদীস- ৬৪২৪)।
সুতরাং মানুষের মনে যখন এই বিশ্বাস থাকে যে, আমার এই ক্ষুদ্র অপ্রাপ্তি, হারানো ও আঘাতের বেদনার বিপরীতে অনেক বড় পুরস্কার ও মহা প্রতিদান রয়েছে তখন কোনো কষ্টেই তার অন্তর আর হতাশ ও ভারাক্রান্ত হয় না। বরং এসব কিছু তাকে আরো আনন্দিত করে।
এই জন্য আমরা দেখি, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সমর্পণের পথ ছেড়ে অন্য পথে সুখ খুঁজেছে, তারা পৃথিবীজোড়া প্রাচুর্য ও সুখের সকল উপকরণ হাতের মুঠোয় জমা করেও কাঙ্ক্ষিত সুখপাখির সাক্ষাৎ পায় নি। কেউ সারাজীবন অতৃপ্তির হাহাকার ও দহনে দগ্ধ হচ্ছে, কেউ এ জীবন থেকে পরিত্রাণের জন্য আত্মহত্যার আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য হাজির করলে আমরা দেখতে পাব, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী পূর্ণ সমর্পিত একজন মানুষও জীবনের ভার বইতে না পেরে আত্মহত্যা করে নি। বাহ্যদৃষ্টে সকল অপ্রাপ্তি সত্ত্বেও সে প্রফুল্ল জীবনের অধিকারী। (সালাত : আল্লাহর সাথে বান্দার মুনাজাত,পৃষ্ঠা: ৮-৯)।