আমাদের রাজনীতির কালপুরুষেরা- পর্ব ২
রহমান মুকুলঃ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গা এলাকায় রাজনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এই জনপদকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছেন, এটি তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য। যাঁরা জীবনের সমস্ত আলো এ জনপদের নিভৃত অন্ধকারে টর্চের মত জ্বেলেছিলেন; জীবনব্যাপী দীপ জ্বেলে গেছেন মাতৃভূমির জঠরে, সেইসব ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠা গৌরবদীপ্ত রাজনীতিবিদদের নিয়ে এ ধারাবাহিক।
ব্রিটিশ ভারতের শাসনামল থেকে আজোবধি নেতৃত্বের ধারাবাহিক কলাম এটি ২) নওয়াজেস আহমেদঃ চুয়াডাঙ্গা জেলার আরেক রাজনীতিক নওয়াজেশ আহমেদ। তিনি চুয়াডাঙ্গা শহরের মনির উদ্দীনের ছেলে। মুসলিমলীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। নওয়াজেশ আহমেদ ১৯০৮ সালে বৃটিশ-ভারতের রানাঘাটের শ্যামনগরের অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক ঐতিহাসিক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। যখন ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসি হয়েছিল ক্ষুদিরাম বসুর। ভারতবর্ষ হারিয়েছিল এক আদ্যপান্ত নির্ভীক সূর্য সন্তানকে। স্বাধীনতার স্বপ্নে যিনি মৃত্যুভয়কেও জয় করেছিলেন। এমন কী, ফাঁসির মঞ্চে তাঁর শেষ কথা চমকে দিয়েছিল সকলকে।
জানা যায়, ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল তিনি বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীর সাথে বিহারের মুজফ্ফরপুরে ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বোমা ছুড়ে হত্যা করতে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত যে গাড়িটিতে তাঁরা বোমা ছুড়েছিলেন তাতে ছিলেন না কিংসফোর্ড। বদলে দুই ইংরেজ মহিলার মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন।
কিন্তু ক্ষুদিরাম ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশদের হাতে। বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিচারক মি. কর্নডফ। রায় ঘোষণার পর ক্ষুদিরামের মুখে ছিল হাসি। অল্প বয়সী ক্ষুদিরামকে বিচারক কর্নডফ প্রশ্ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ফাঁসিতে যে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কিনা? স্বাধীনতার আকাঙ্খায় এমনই নির্ভীক ছিলেন মেদিনীপুরের এই বিস্ময় যুবক। ১০ আগস্ট আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, 'রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জহরব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।' তিনি বলেছিলেন যে, তিনি বোমা বানাতে জানেন। ব্রিটিশদের অনুমতি পেলে সেই বিদ্যা ভারতের অন্যান্য যুবকদের শিখিয়ে যেতে চান। আর ফাঁসির আগে ক্ষুদিরামের শেষ ইচ্ছা কী ছিল জানেন? ফাঁসির মঞ্চে এসেও যে প্রশান্তি ছিল তাঁর মনে, তা সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল।
১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। ক্ষুদিরামকে সেই মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের চার পুলিশ। ক্ষুদিরাম ছিলেন তাঁদের সামনে। ফাঁসির আগে উপস্থিত আইনজীবীদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর পিঠমোড়া করে বাঁধা হয় দুইহাত। গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্র জল্লাদকে ক্ষুদিরাম প্রশ্ন করেছিলেন 'ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?' এটাই ছিল বীর শহিদের জীবনের শেষ কথা। জল্লাদ বিস্ময়ে কিছু বলতে পারেননি। এমনই এক ঐতিহাসিক সময়ে জন্ম ও নাটকীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠা নওয়াজেশ আহমেদের। তিনি ১৯২৮ সালে ভারতের মাজদিয়া রেলবাজার এইচ ই স্কুল থেকে ১ম শ্রেণিতে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন।
১৯৩০ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ১ম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও এলএলবি পাশ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি রানাঘাট আদালতে ওকালতি শুরু করেন। দেশ বিভাগের আগেই তাদের পরিবার চুয়াডাঙ্গার দামুঢ়হুদা উপজেলার বাস্তপুর চলে আসেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অল্প সময়েই মুসলিমলীগের অপরিহার্য নেতায় পরিণত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান। তিনি চুয়াডাঙ্গা আদালতের প্রভাবশালী উকিল ছিলেন। দীর্ঘ বছর তিনি চুয়াডাঙ্গা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট পূর্ব বাংলার গর্ভণর নিযুক্ত হন চুয়াডাঙ্গার সন্তান ডাক্তার এ এম মালিক। এরপর পরই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক সরকার গঠণ করেন।
এ সরকারে চুয়াডাঙ্গার আরেক সন্তান নওয়াজেশ আহমেদ মন্ত্রি হন। এ মন্ত্রিসভায় অন্যান্যরা হলেন – অধ্যাপক শামসুল হক, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, এ এস এম সোলায়মান, মাওলানা ইসহাক, একে মোশারফ হোসেন, আবুল কাশেম, আক্তার উদ্দীন আহমেদ, মাওলানা একে এম ইউসুফ, মাওলানা আব্বাস আলী খান, জসিম উদ্দীন আহমেদ, মজিবর রহমান প্রমুখ। যদ্দুর জানা যায়, ইতোপূর্বে ১৯৪৬ সালেও তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৪৬ সালে বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য একটা আলাদা আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ত্বরান্বিত হয়। এ প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ৪৯৫টি আসনের মধ্যে মুসলীমলীগ ৪২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। নির্বাচন শেষে গণতন্ত্রের মানসপুত্রখ্যাত শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ মন্ত্রিসভায় মুসলিমলীগের তরুণ নেতা নওয়াজেশ আহমেদ বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি ও পরবর্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টিতে তিনি সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ও কায়েদে আজম জিন্নাহ’র অন্যতম সহযোগি ছিলেন। অ্যাড নওয়াজেশ আহমেদের ৩ ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তের চেয়ারম্যান ছিলেন। সন্তানদের সকলেই বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করেন। কয়েক বছর পর পর দেশে আসেন। কিছু বেশি সময় দেশে অবস্থান করেন ছোট মেয়ে অধ্যাপক জিএমএম আকতার জাহান। তিনি বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা শহরের কোর্ট রোডে অবস্থিত পৈত্রিক বাড়ি “শরণ”-এ অবস্থান করছেন। তিনি জানান, বাস্তুপুরে নওয়াজেশ আহমেদের জমিতেই গ্রামের সকল প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। তাছাড়া, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের ৯টি গ্রামে তাঁর জমিদারী ছিল। এছাড়া তিনি ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে জমি দান করেন।
২০০০ সালের ১৩ মার্চ তিনি চুয়াডাঙ্গার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। ( চলবে)।
বি:দ্র: ছবি সংগ্রহে রীতিমত ব্যর্থ হয়েছি।