আমাদের রাজনীতির কালপুরুষেরা
রহমান মুকুলঃ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গা এলাকায় রাজনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে এই জনপদকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছেন, এটি তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য। যাঁরা জীবনের সমস্ত আলো এ জনপদের নিভৃত অন্ধকারে টর্চের মত জ্বেলেছিলেন; জীবনব্যাপী দীপ জ্বেলে গেছেন মাতৃভূমির জঠরে, সেইসব ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠা গৌরবদীপ্ত রাজনীতিবিদদের নিয়ে এ ধারাবাহিক। ব্রিটিশ ভারতের শাসনামল থেকে আজোবধি নেতৃত্বের ধারাবাহিক কলাম এটি।
(১) ডাক্তার আব্দুল মোত্তালিব মালিকঃ ব্রিটিশ কলোনিয়ালভূক্ত ভারত উপমহাদেশ যখন উত্তাল বঙ্গভঙ্গ ইস্যু নিয়ে, মুসলমানরা যখন ঢাকা, রাজশাহী, চট্রগাম বিভাগ ও আসাম নিয়ে নতুন আবাসভূমির স্বপ্নে বিভোর, সেই ১৯০৫ সালের উত্তাল সময়ে ডাক্তার আব্দুল মোত্তালিব মালিক (এ এম মালিক) জন্মগ্রহণ করেন চুয়াডাঙ্গা শহরের সম্ভ্রান্ত মল্লিক পরিবারে। মন্তান্তরে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সারা উপমহাদেশে তিনি ডাক্তার এ এম মালিক হিসেবে পরিচিত হলেও আসল নাম আব্দুল মোত্তালিব মালিক। পিতার নাম আতাহার হোসেন মালিক।
তিনি অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র ছিলেন। তিনি বগুড়া, ভারতের বাকুড়া ও কলকাতায় পড়াশোনা করেন। ভিয়েনা থেকে তিনি চক্ষু চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া শেষে রাজনীতিতে যোগ দেন। তাছাড়াও, তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ডাক্তার মালিক পাকিস্থান শাসনামলে একাধিকবার মন্ত্রি ছিলেন। বেশ কয়েকবার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাকিস্থানের সর্বময় ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করেন। ১৯৪০ ও ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি অতিরিক্ত চিফ হুইপ ছিলেন।
১৯৮৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির বছরে পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভায় সমবায়, বন ও মৎস্য মন্ত্রি ছিলেন। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমে সংখ্যালঘু সম্পর্ক,শ্রম ও শ্রমিক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রি ও পরে সংবিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন। প্রেসিডেন্ট নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দীনের মন্ত্রিসভায়ও মন্ত্রি ছিলেন। তিনি ১৯৩৬ সালে মুসলিমলীগে যোগদান করেন। অসাধারণ নেতৃত্ব দানের প্রতিভাসম্পন্ন ডাক্তার মালিক খুব অল্প সময়েই অর্থাৎ মাত্র ১ বছরের আগেই মুসলিমলীগ পার্লামেন্টারি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সাল অর্থাৎ রাজনীতিতে যোগদানের পরের বছরই ব্রিটিশ ভারতের প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।এ সময়ই তিনি শ্রমিক নেতা হিসেবে উপমহাদেশে পরিচিত হয়ে উঠেন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পূর্বেই তিনি বাংলা প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন ও নাবিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি একাধিকবার শ্রমিক উপদেষ্টা হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সঙ্ঘের সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। প্রেস ইমপ্লয়েজ ইউনিয়ন, ডকার্স ইউনিয়ন ও পোর্ট কমিশনার্স ইউনিয়নের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। সর্বভারতী সি-ফেয়ারার্স ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি আইএলও’র চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সুইজারল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুগোস্লাভাকিয়া, চীন, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে আগস্টের শেষ দিকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ সময় তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিন্দিত হন। কী রাজনীতিবীদ, কী দায়িত্বশীল মন্ত্রি, কূটনীতিক বা শ্রমিক নেতা – সবক্ষেত্রেই তিনি অসামান্য সাফল্য ও মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের রাজনীতিতে নেতৃত্বদানকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার গৌরব অসামান্য। জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দানের অনন্যসাধারণ গুণাবলীর কারণে তিনি আরও বহু যুগ অম্লান থাকবেন।
সেবার জগতেও তিনি অনন্য দ্যূতি ছড়িয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তান রেডক্রস সমিতি, এতিম ও অন্ধ ত্রাণ সমিতি ও ত্রাণ পূণর্বাসন প্রভৃতি সেবামূলক কর্মকান্ডেও নেতৃত্ব দিয়েছেন সমানভাবে। চুয়াডাঙ্গায় তার নামে একটি চক্ষু হাসপাতাল রয়েছে। তাছাড়া ডাক্তার মালিকের জমিতেই চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত (শাহজাহান জোয়ার্দ্দার)। তিনি সৎ ও মৃদুভাষী হিসেবে সমাদৃত হতেন। এই সংবেদনশীল অমিত মেধাবি রাজনীতিকের ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ১৯৭৭ সালে ৭২ বছর বয়সে এই বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জন্মভূমি চুয়াডাঙ্গায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।