নবীর অপমানে উম্মত পাগলপারা হয়ে ওঠে কেন
মাওলানা ইমদাদুল হক
আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ মাত্রেই তার পরিবারের নারী, তথা মা বোন স্ত্রী কন্যার অপমানে ফুঁসে ওঠে। পাগলপারা হয়ে যায়। কেননা তারা তার আপনজন, সে তাদেরকে ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে, এদের সম্মান ও অপমানের সাথে তার নিজের মান-অপমানও জড়িত। এরা কেউ অপমানিত হলে তার মানও থাকে না।
এ সকল বিষয় উম্মত ও নবীজির মাঝে আরও সহস্র গুণ অধিকহারে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি উম্মতের কাছে সব থেকে, সবার থেকে, এমনকি নিজের প্রাণ থেকেও প্রিয় ও আপনজন। তাঁর সম্মানেই উম্মতের সম্মান, তাঁর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হলে উম্মতের কোনো মর্যাদাই আর থাকে না। তাঁকে ভালোবাসা ঈমান। তাঁকে সর্বাধিক ভালোবাসতে না পারলে ঈমানের দাবি অর্থহীন হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ বলেন, নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের প্রাণ অপেক্ষা অধিক নিকটজন এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা (সূরা আহযাব, আয়াত: ৬)। এ আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের পিতৃস্থানীয়। উপরন্তু হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য, তোমাদেরকে আমি দ্বীন শিক্ষা দিয়ে থাকি (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-৮)।
ই সম্পর্কের নৈকট্য আর উম্মতের প্রতি তাঁর যে করুণা ও অবদান, এর দাবিতে উম্মতের কাছে ভালোবাসা তাঁর পাওনা। মহান আল্লাহ বলেন, (হে নবী, আপনি আপনার উম্মাতকে) বলে দিন, আমি এসব কিছুর বিনিময়ে তোমাদের কাছে নিকটসম্পর্কজনিত ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাই না (সূরা শুরা, আয়াত: ২৩)।
তাই কেউ যদি নবীজিকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসতে না পারে তার ঈমানের দাবি গ্রহণযোগ্য হয় না। বরং সে আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায়। মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী, (আপনি আপনার উম্মতকে) বলে দিন, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা থেকে তোমাদের পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী, গোত্র, অর্জিত ধনসম্পদ, মন্দার আশঙ্কাপূর্ণ ব্যবসা এবং ভালোবাসার বাসস্থান অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর শাস্তি আসা পর্যন্ত। আল্লাহ এসব অবাধ্যদের মুক্তির পথ দেখান না (সূরা তওবা : ২৪)।
আবু হুরাইরা রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র হই (সহীহ বুখারি, হাদীস-১৪)। আনাস রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান, পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ ও সব মানুষের অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হই (সহীহ বুখারি, হাদীস-১৫; মুসলিম, হাদীস-৪৪; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-১২৮১৪)।
আবদুল্লাহ ইবন হিশাম রা. বলেন, আমরা একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন উমার ইবনুল খাত্তাব রা.-এর হাত ধরেছিলেন। উমার রা. তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার প্রাণ ছাড়া আপনি আমার কাছে সব কিছুর চেয়ে অধিক প্রিয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না, যাঁর হাতে আমার প্রাণ ওই সত্তার কসম! তোমার কাছে আমি তোমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় না হওয়া পর্যন্ত নয়। তখন উমার রা. তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে উমার, এখন (তুমি সত্যিকার ঈমানদার হলে) (সহীহ বুখারি, হাদীস-৬৬৩২)।
নবীজিকে ভালোবাসার পুরস্কারও অতুলনীয়। আনাস ইবন মালিক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেছেন, হে বৎস, তুমি যদি সকাল-সন্ধ্যা এমনভাবে কাটাতে পার যে, তোমার অন্তরে কারো প্রতি কোনো রকম বিদ্বেষ নেই, তাহলে তাই করো। তিনি আমাকে পুনরায় বললেন, হে বৎস, এটা হল আমার সুন্নাত। আর যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে জীবিত করল, সে আমাকেই ভালোবাসল, আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসল সে তো জান্নাতে আমার সাথেই থাকবে (সুনান তিরমিযি, হাদীস-২৬৭৮)। আলী ইবন আবু তালিব রা. হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসান ও হুসাইনের হাত ধরে বলেন, যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে এবং এ দু’জন ও তাঁদের পিতা-মাতাকে ভালোবাসে, সে কিয়ামাতের দিন আমার সাথে একই মর্যাদায় থাকবে (সুনান তিরমিযি, হাদীস-৩৭৩৩)।
নবীজির অপমানে উম্মত তাই অস্থির, বেসামাল ও পাগলপারা হয়ে ওঠে। এ তাদের ঈমান, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাবোধের প্রকাশ ও দাবি। তাঁর অপমানে যার অন্তর কাঁদে না তার ঈমানের দাব যথার্থ নয়।
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।।