শ্রীনগরে পাকা ঘরের লেউ কাটতে গিয়ে এক সময়ের পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম কড়ি উদ্ধার নিয়ে হৈচৈ
আলমডাঙ্গার শ্রীনগর গ্রামে পুরাতন ভিটায় নতুন করে পাকা ঘরের লেউ কাটতে গিয়ে পণ্য বিনিময়ের পুরাতন মাধ্যম কড়ি উদ্ধার হয়েছে। সম্প্রতি মৃত বজুল লস্করের ছেলে ডিদু লস্করের নির্মিতব্য ঘরের লেউ কাটার সময় মাটির নীচ থেকে এক কলস ( আনুমানিক ১৫ কেজি) কড়ি ও কালো রঙের একটি মাটির ঘট উদ্ধার করা হয়েছে। এলাকায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে এ ঘটনা।
আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটখোলা পাঁচলিয়ার শামীম হোসেন ওই নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, “কয়েক দিন আগে ঘরের লেউ কাটতে গিয়ে মাটির নীচে একটা মাটির কলস পাওয়া যায়। কোদালের কোপে কলসটির মুখ ভেঙ্গে যায়। এতে বেশ কিছু কড়ি বের হয়। এ কথা অন্যান্যকে জানালে শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে সব কড়ি উদ্ধার করেছেন। ঘরের অন্যদিকে লেউ কাটতে গিয়ে মাটির ঘটের মত একটা কিছু পেয়েছিলাম। আর অন্য কিছু পায়নি।“
নির্মাণাধীন ঘরের মালিক ডিদু লস্কর জানান,“মাটির নীচে শুধু কড়ি পেয়েছি। পাড়ার সকলেই দেখেছেন। অন্যকিছু পায়নি। গ্রামের অনেকেই দেখতে এসে সে কড়ি নিয়ে যাচ্ছে। আমরা কী করবো এখন এ সকল কড়ি দিয়ে? তাই কেউ চাইলেই দিয়ে দিচ্ছি।“
গ্রামের অনেকেই জানান, ডিদু লস্করের পূর্বপুরুষ খোরশেদ মিয়া ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। হয়তো তাদের সম্পদই ওই কড়ি। বিনিময়ের মাধ্যম কড়ি যখন তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে, তখন আর বাতিল মুদ্রা কড়ি নিয়ে তাদের আগ্রহ ছিল না। লস্করদের এখন অনেক শরিক ( বংশধর) গ্রামে। তাদের অনেকেই ধারণা করছেন যে লস্করদের কোন শরিক হয়তো কড়ি উদ্ধারের ঘটনাকে অতি রঞ্জিত করতে চাইছেন।
ঘটনাস্থল গতকাল আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ পরিদর্শন করেন।
উল্লেখ্য, একসময় বাংলায় লেনদেন চলতো কড়ি দিয়ে। কালের বিবর্তনে আস্তে আস্তে তা ধাতব মুদ্রা বা কাগজের টাকায় রূপান্তরিত হয়। কড়ি শব্দটি হিন্দি ‘কৌড়ির’ পরিবর্তিত রূপ। সংস্কৃতে ‘কপর্দ’ অথবা ‘কপর্দক’। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’, ‘হিসাবের কড়ি বাঘে খায় না’, ‘গাঁটের কড়ি’একদা বহুল জনচল এহেন শব্দবন্ধের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে বাংলার সমাজে, অর্থনীতিতে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কড়ির ভূমিকা ছিল বিশাল। তখন বাংলার সর্বত্রই কড়ি দিয়ে কেনাবেচা হতো।
মৃত সামুদ্রিক প্রাণীর শক্ত খোলস হলো কড়ি। বিদেশ থেকে আমদানি করা জিনিসটি হাত ফেরতা হতে হতে বাংলার আর্থিক ও সামাজিক জীবনের অস্থিমজ্জায় মিশে গিয়ে কাব্য, সাহিত্য আর প্রবচনের অন্দরমহলে শক্ত ঠাঁই খুঁজে পেয়েছিল।
মৌর্যযুগে সরকারি কর্মচারী ও কারিগরদের বেতন দেওয়া হতো কড়ির হিসাবে। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্বে লিখেছেন, গুপ্তযুগ থেকে বাংলাদেশে মুদ্রার নিম্নতম মান ছিল কড়ি।
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য আখ্যানে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে কড়ি বা কপর্দকের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তৃত উল্লেখ রয়েছে। এখনও কড়ি ও কপর্দক শব্দদ্বয় বাংলা ভাষায় চালু আছে, তবে ঠিক মুদ্রা অর্থে নয়, আর্থিক পরিস্থিতি বুঝায় এমন অর্থে। সে যুগে রৌপ্যমুদ্রা প্রচলিত থাকলেও এর ব্যবহার শহর ও বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে কড়িই ছিল ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান মাধ্যম। সেন বংশের তাম্রশাসনে দেখা গিয়েছে ভূমির বার্ষিক আয় কপর্দক পুরাণের হিসাবে নির্ধারিত হতো । একসময় ভারতে ভূমি রাজস্ব ও রৌপ্যমুদ্রায় ধার্য হতো। বাংলায় গুপ্ত যুগে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল। গুপ্ত যুগের পরেও বাংলার রাজারা স্বর্ণমুদ্রা চালু রেখেছিলেন। কিন্তু সেই সব স্বর্ণ মুদ্রা ছিল অতি নিকৃষ্ট ধরনের অত্যধিক খাদ- মিশ্রিত। অতঃপর রৌপ্য মুদ্রার অভাব দেখা দেওযায় বাংলা ও বিহারে কড়ির প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তিতে ধাবত ও কাগজের মুদ্রার প্রচলন চালু হলে আস্তে আস্তে কড়ির প্রচলন শেষ হয়।