১১ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোরখোদকদের "ভাতের পাতে লবণের ব্যবস্থা হোক"

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
জুলাই ১০, ২০২১
83
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 


রহমান মুকুলঃ "দূরের আসমানে জ্বলে দিনার।/কোদালে অবহেলে উপড়ে আনি/ মাটির ঢেলা আর মড়ার খুলি।/ শরিফ কেউকেটা কী করে চিনি?/ কোরো না বেয়াদবি বান্দা তুমি।/ বাদশা নেই কেউ, গোলাম সব,/ বেগম চায় পেতে বাঁদীর সুখ/ আউড়ে গেছে কত সত্য পীর।/ সাচ্চা শুধু এই দেহের দাবি।/ মানতে নয় রাজি বেয়াড়া মন/ দীন ও দুনিয়ার ধাপ্পাবাজি।"
শামসুর রাহমানের কবর খোঁড়ার গান কবিতার অংশ বিশেষ উপরোক্ত উদ্ধৃতাংশটি। উদ্ধৃতিটিতে গোরখোদকদের কষ্ট ও মর্মবেদনা প্রষ্ফুটিত হয়েছে। গোর খোঁড়ার কাজ নিঃসন্দেহে শ্রমসাধ্য। যারা কাজটি করেন তারা দরিদ্র মানুষ। শ্রমিক ও মজুর শ্রেণির। যারা দিন আনেন দিন খান এমন দরিদ্র। কোন আর্থিক মূল্য কিংবা অন্য কোন বিনিময় ব্যতিরেকেই তাঁরা এ কাজটিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।


সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ গোর খোদকেরা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ বিবেচনা থেকেও তাঁরা অত্যন্ত মর্যাদার দাবিদার। অথচ, রাষ্ট্রের কাছে এ বিনিময়বিহীন মহান পেশাজীবীরা বড়ই গুরুত্বহীন। তাঁদেরকে সরকারিভাবে কোন অনুদান দেওয়া হয়না। সমাজের অনেক পেশাজীবীদেরকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত করা হলেও গোর খোদকরা সামাজিক সুরক্ষা বেষ্ঠনীর বাইরে রয়ে গেছেন। তাদের অভাব অভিযোগের খবর নেওয়ার কেউ নেই।


প্রায় দশ হাজার লোকের বসবাস আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া-নগরবোয়ালিয়া গ্রামে। এই গ্রামের গোরখোদক হিসেবে অধিক পরিচিত ফজলুল হক (৫০), আশা উল্লাহ(৬০), হিম বক্স(৫৭), আতিয়ার রহমান (৪৮), সিরাজুল ইসলাম, মোহাব্বত আলী ও ঠান্ডু।


গোরখোদক ফজলুল হক জানান, তিনি দিনমজুর। এ পর্যন্ত আড়াই শ কবর খুঁড়েছেন। যেদিন কবর খোঁড়ার ডাক আসে, সেদিন দিনমজুরের কাজ ফেলে রেখে ছুটে যেতে হয় কবরস্থানে। কাজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায় অনেক দিন। সেদিন হয়তো নিজেও না খেহে থাকি। পরিবারের অন্যদের হয়তো সেদিন ১ বেলা খেয়ে কাটাতে হয়। এ কষ্টের কথা তো বলা যায় না। কোবোড় খঁড়ার জন্য টাকাও নেওয়া যায় না।
আশাউল্লাহ (৬০) জানান, "তিনি প্রায় ৩ শ কবর খুঁড়েছেন। এমন দিনও গেছে যেদিন ৩ টি কবর খুঁড়েছেন।"


গোরখোদক আতিয়ার রহমান (৪৮) পেশায় ভ্যানচালক। তিনি জানান, "গরীবরা অনেক ধরনের সরকারি সাহায্য পায়। ভিজিএফ, ১০ টাকার চাল, বয়ষ্কভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা। অথচ, আমরা কোন সাহায্য পাইনা। আমাদের কথা কেউ ভাবে না।"
নগরবোয়ালিয়া গ্রামের সন্তান মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুত সমিতির সভাপতি জিনারুল ইসলাম বিশ্বাস বলেন, " সত্যি বলতে কী - আমরা গোরখোদকদের উপকারের কথা মনে রাখি না। যখন আমাদের স্বজনদের কেউ মারা যান, তখন বুঝি যে গোরখোদকরা কত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের পাশাপাশি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকেও এদের অবদানের কথা মনে রেখে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সাহায্য করা উচিত। "
শত অভাব সত্বেও শ্রমের মূল্য পাওয়ার কোনরূপ প্রত্যাশা না করে যারা ডাকা পাওয়া মাত্র ছুটে গিয়ে মানুষের শেষ ও চিরকালীন ঘর তৈরি করে দেন, তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের সদয় হওয়া উচিত। গোরখোদকদের জীর্ণশীর্ণ দেহ ও ভাঙ্গাচোরা মুখের উজ্জ্বল চোখের চাহনি যেন ফিসফিসিয়ে বলছে -
" আমরা তো সামান্য লোক।
আমাদের ভাতের পাতে
লবণের ব্যবস্থা হোক।" ( জয় গোস্বামী)

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram