কোটচাঁদপুরে ৮০ বছর পর জনমানব শূন্য গ্রামে আবার শুরু হয়েছে মানুষের বসবাস
জাহিদুর রহমান তারিক, স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ- মঙ্গলপুর গ্রামটির নাম কাগজে থাকলে ও দীর্ঘ বছর কোনো বসতি ছিল না ঐ গ্রামে। প্রায় ৮০ বছর পর জনমানব শূন্য গ্রামে আবার শুরু হয়েছে মানুষের বসবাস। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয় প্রকল্প-২ এর আওতায় আট পরিবার এই গ্রামে বসবাস শুরু করছে। তাদের প্রত্যেক কে ঘর ও দুই শতক জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পার্শ্ববর্তী বাগডাঙ্গা, পাশপাতিলা ও বলাবাড়িয়া গ্রামের আট ভূমিহীন পরিবারকে এই ঘর দেওয়া হয়। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে।
মঙ্গলপুর গ্রামটি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে। কোটচাঁদপুর শহর থেকে চৌগাছা সড়ক ধরে তিন কিলোমিটার পথ গেলেই রাস্তার বাম পাশে দেখা মিলবে গ্রামটির। ইউনিয়ন ভূমি অফিস বলছে, মঙ্গলপুর গ্রামটি উপজেলার ৬৬ নম্বর মঙ্গলপুর মৌজায় অবস্থিত। এই মৌজায় একটিই গ্রাম রয়েছে যার নাম মঙ্গলপুর। গ্রামে ২০৬টি খতিয়ানভুক্ত জমি আছে কিন্তু সেখানে কোনো পরিবারের বসবাস ছিল না। রোববার সকালে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘর হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করার পর কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে ওই আট পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করা হয়। এ সময় সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চল, উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুন্নেছা মিকি ও এলাঙ্গী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানসহ বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করে।
ইতোমধ্যে তাদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মঙ্গলপুরে ঘর পাওয়া সবিতা দাস ও খোকন দাস জানান, আমরা ঘর ও জমি পেয়ে খুবই খুশি। কথিত এই গ্রামের অমঙ্গল নিয়ে ভিত নই। তাদের ভাষ্য, এখন মানুষ আর রোগ নিয়ে ভয় পায় না। সচেতন হলেই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মঙ্গলপুর গ্রামে থাকা পুকুর রাস্তাসহ কয়েকটি বাড়ির সামান্য ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যায় এখানে একসময় জনবসতি ছিল। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ বছর আগে 'মঙ্গলপুর' নামের এই গ্রামের মানুষের মধ্যে অমঙ্গল আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কলেরা বা গুটি বসন্তের মতো মহামারি রোগে এখানকার অনেকে মারা যায়।
এ সময় প্রাণে বাঁচতে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকে গ্রামটি মানুষ শূন্য হয়ে পড়ে। কোটচাঁদপুর এলাকার প্রবীন ব্যক্তি মোশারফ হোসেন জানালেন, '৭০ থেকে ৮০ বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ মারা যায়। এ আতঙ্কে গ্রামের মানুষ আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। তবে তারা আর ফিরে আসেনি। আর কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যান।' পার্শ্ববর্তী পাশপাতিলা গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম জানান, 'আমরা লোকমুখে শুনে আসছি এ গ্রামে একসময় মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু মহামারি আতঙ্কে গ্রামের সবাই পালিয়ে যায়। সেই থেকে মঙ্গলপুর গ্রামকে সবাই অমঙ্গলপুর বলে জানে। তবে সরকারের বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ওই গ্রামের ভূমিহীন কিছু মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে এটা ভালো। সরকারের চেষ্টায় অমঙ্গলপুরে মঙ্গলের হাওয়ায় অজানা আতঙ্ক কেটে যাবে বলে যোগ করেন এই বাসিন্দা।'
পার্শ্ববর্তী বলাবাড়িয়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম জানান, 'মঙ্গলপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু স¤প্রদায়ের ছিল। গ্রামে যখন কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে তখন অনেক মানুষ মারা যায়। ওই সময় গ্রামে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের খাল-বিল, পুকুর-কুয়ার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। এই প্রচারের পর গ্রামের মানুষ দল বেঁধে ভারতে চলে যায়। কিছু মানুষ পাশের গ্রাম গুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল, যারা পরে অন্যত্র চলে যায়। তিনি আরও জানান, সর্বশেষ নেটে ঠাকুর নামের একজন মঙ্গলপুরে থাকতেন, তিনি পরবর্তীতে খুন হলে গ্রামটি সম্পূর্ণ ভাবে মানুষ শূন্য হয়ে পড়ে।' এলাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম মঙ্গলপুর। এই গ্রামে দীর্ঘদিন মানুষের বসবাস ছিল না। সরকারের এ উদ্যোগে আস্তে আস্তে গ্রামে আরও বসতি গড়ে উঠবে এ প্রত্যাশা রাখি।