মেহেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে মানুষ
মেহেরপুর \ গাছের নাম কাঁঠাল গাছ। কাঁঠাল রসালো ও সুস্বাদু একটি ফল। চলতি মৌসুমে মেহেরপুরে জাতীয় ফল কাঁঠালের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে মনে করছেন চাষীরা। বাজারে পাকা কাঁঠাল উঠতে শুরু করেছে। দামও মানুষের চাহিদার মধ্যে। মেহেরপুরে ১লক্ষ ৪৬ হাজার কৃষি পরিবারের মাঝে কাঠাল চাষের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করেছে কৃষি বিভাগ । প্রতিটি পরিবার যেন তাদের বাড়ির আশেপাশে কাঠাল চাষ করে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশ বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে কাঁঠালের উৎপত্তি স্থান হিসেবে বিবেচিত।
কাঁঠাল (ইংরেজি নাম-ঔধপশভৎঁরঃ) বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার এটি অতি আদিম ফল। বাংলাদেশের সর্বত্রই কাঁঠাল পরিদৃষ্ট হয়। সাধারণত লালচে মাটি ও উঁচু এলাকায় এটি বেশি দেখা যায়। বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনে শীর্ষে ভারত, এরপরেই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ ও ভারতে চাষকৃত জাতসমূহ দুই ধরনের। গালা ও খাজা - এ দুটি জাত ছাড়াও কাঁঠালের আরো জাত আছে। গালা ও খাজা কাঁঠালের মাঝামাঝি রয়েছে ‘রসখাজা’। এছাড়া আছে রুদ্রাক্ষি, সিঙ্গাপুর, সিলোন, বারোমাসী, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদ্মরাজ, হাজারী প্রভৃতি। তন্মধ্যে শুধুমাত্র হাজারী কাঁঠাল বাংলাদেশে আছে, বাকীগুলো আছে ভারতে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, মেহেরপুর জেলার ৩টি উপজেলার নির্ধারিত বাগান ছাড়াও সবচেয়ে বেশী সড়ক-মহাসড়ক, গ্রামীণ জনপদ, হাট-বাজার এবং বাড়ির আঙ্গিণায়ও কাঁঠালগাছ বেড়ে উঠেছে। ব্যক্তি মালিকানায় কাঁঠালগাছ রোপণ করা হয়। প্রায় ৫১৫ হেক্টর জমিতে কাঁঠালের চাষ হয়েছে। এ বছর কাঁঠালের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার মণ। রাস্তার পাশ দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই কাঁঠাল গাছ রোপণ করে থাকেন। কোনো ধরনের সার, কীটনাশক এমনকি বিশেষ পরিচর্যা ছাড়াই এ গাছ আপন গতিতে বেড়ে ওঠে।
জেলার প্রতিটি উপজেলার গাছগুলোতে প্রচুর কাঁঠাল ধরেছে। উৎপাদিত কাঁঠাল জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হবে। কাঁঠালের সবচেয়ে বড় গুণ হলো এর কোনো অংশই ফেলে দিতে হয় না। কাঁঠালের রস থেকে প্রচুর ভিটামিন ও ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। কাঁঠালের বিচি এবং কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে তরকারি রান্না করে খাওয়া যায়। কাঁঠালের খোলস ও পাতা গবাদিপশুর খাবার। তাই কাঁঠাল গাছ লাগিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। সদর উপজেলা সীমান্তবর্তী ষোলমারি গ্রামের সোহানুর রহমান সোহান বলেন, মেহেরপুরে আমের পরেই কাঁঠালের স্থান। সব শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাঁঠালের চাহিদা ব্যাপক। পাকা কাঁঠালের চেয়ে সবজি হিসেবে কাচা কাঁঠালের চাহিদা মেহেরপুর জেলার সর্বস্তরের সর্বগোত্রের মধ্যে সমান জনপ্রিয়।
পরিপূর্ণ বয়সের কাঁঠালকাঠ অন্যান্য কাঠের চেয়ে বেশী দামে বিক্রি হয়ে থাকে। কাঁঠালপাতা ছাগলের খাদ্য হওয়াতে অনেকে কাঁঠালগাছ রোপণ করে পাতা বিক্রির জন্য। কাঠালের উপকারিতা জানতে চাইলে ডাঃ স্বাধিন জানান, কাঁঠালে বিদ্যমান আয়রন দেহের রক্তাল্পতা দূর করে। ছয় মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে কাঁঠালের রস খাওয়ালে শিশুর ক্ষুধা নিবারণ হয় এবং অন্যদিকে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়। গর্ভবতী মহিলারা কাঁঠাল খেলে স্বাস্থ্য স্বাভাবিক থাকে এবং গর্ভস্থ সন্তানের বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়। দুগ্ধদানকারী মা তাজা পাকা কাঁঠাল খেলে দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ ফল আঁশালো বিধায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। সদর উপজেলা বুড়িপোতা ইউপি চেয়ারম্যান শাহ জামান বলেন, জেলার বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কের পাশে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাছ লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় কাঁঠাল গাছ লাগানো হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে রাস্তার দু‘ধারে কাঁঠালগাছ রোপণ করা হচ্ছে প্রতিবছরই। তিনি আরও বলেন, মেহেরপুরে আনাচে-কানাচে কাঁঠালের গাছ দেখা যায়।
এলাকার গ্রামের শ্রমজীবী আপামর জনসাধারণের কাছে কাঁঠালের চাহিদা রয়েছে। কাঁঠালের মতো এত বেশি পুষ্টি উপাদান আর কোনো ফলে পাওয়া যায় না। কাঁঠালের দাম অন্যান্য ফলের তুলনায় কম হওয়াতে গরিব মানুষ এটা খেতে পারে। তাই কাঁঠালকে গরিবের ফল বলা হয়। সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাসরিন পারভীন বলেন, কাঁঠাল পুষ্টি সমৃদ্ধ। এতে আছে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানব দেহের জন্য বিশেষ উপকারী। তিনি বলেন, পাকা কাঁঠালে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। কাঁঠালে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান ম্যাঙ্গানিজ, যা রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কৃষি বিভাগ থেকে মেহেরপুরের প্রতিটি পরিবার ও চাষীদের কে কাঠাল চাষ করা জন্য পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারনের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ জানান, জেলায় এ বছর কাঁঠালের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩ নামে তিনটি উচ্চফলনশীল জাত অবমুক্ত করেছে। সর্বশেষ জাতটিতে অমৌসুমে অর্থাৎ অক্টোবর-মে পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, হাজারী কাঁঠাল নামে অতি জনপ্রিয় একটি জাত রয়েছে, ছোট ছোট অনেক ফল ধরে থাকে। কখনও কখনও ৩০Ñ৩৫ কেজি, এমনকি ৪০ কেজি ওজনের কাঁঠাল দেখতে পাওয়া যায়। উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সারা বছর যাতে কাঁঠাল উৎপাদন করা যায় এ জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।