৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাগরেদের স্ত্রী হত্যামামলায় গ্রেফতার এরশাদপুরের বহুল আলোচিত পান্টু হুজুরসহ ৩

প্রতিনিধি :
শরিফুল ইসলাম রোকন
আপডেট :
মে ২, ২০২১
88
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 


আলমডাঙ্গার এরশাদপুরের বহুল আলোচিত পান্টু হুজুরকে এবার সাগরেদের স্ত্রী হত্যা মামলায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় পুলিশ আরও ২ আসামীকে গ্রেফতার করেছে। ইতোপূর্বে ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করা, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করাসহ একাধিক অভিযোগে একাধিকবার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। তাছাড়া ফুঁসলিয়ে অন্যের স্ত্রী, যুবতীদের নিজের আখড়ায় রাখা, যুবতীদের নিয়ে এসে গানের আসর বসানো, রোগ চিকিৎসার নামে প্রতারণা করার নানা অভিযোগেও ইতোপূর্বে পুলিশ তাকে আটক করেছিল।


এজাহারসূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বাথানপাড়ার আব্দুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি অসুস্থ হলে তিনি নিজের বিধবা যুবতী কন্যা মুক্তা মালাকে (৩২) নিয়ে আলমডাঙ্গার এরশাদপুর গ্রামের পান্টু হুজুরের দরবারে যান চিকিৎসা হতে। সে সময় পান্টু হুজুরের খাদেম হিসেবে পরিচিত এরশাদপুর গ্রামের ইছাহক আলীর ছেলে জহুরুল ইসলামের সাথে মুক্তামালার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরইএক পর্যায়ে ৬/৭ মাস পূর্বে তারা পরষ্পর বিয়ে করে। বিয়ের পর মুক্তামালা স্বামীর সাথে পান্টু হুজুরের আশ্রমেই বসবাস করতেন।

হুজুরের খাদেম হিসেবে ওই দরবার শরীফে আরও অনেক মেয়ে ও পুরুষ বসবাস করে। বিয়ের পর থেকেই জামাই জহুরুলের মা জহুরা খাতুন বউমা মুক্তামালাকে ভালোভাবে নেননি। নানা অত্যাচার করতেন। খেতে দিতেন না। ঘরের ভেতর আটকে রাখতেন। ছেলে জহুরুল ও পান্টু হুজুরকে ফুঁসলাতেন। তারা সকলে মিলে মুক্তামালার উপর অমানসিক অত্যাচার শুরু করে। এক পর্যায়ে গত ২ মে সকাল ৮টার দিকে মুক্তামালাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে লাশের গলায় উড়না পেচিয়ে পান্টু হুজুরের ঘরের আড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখে। পরে লাশ দরবারের নিজস্ব ভ্যানে করে বাপের বাড়ি গাংনী উপজেলার বাথানপাড়ায় পাঠিয়ে দেন। ঘটনাটি কাউকে না বলতে হুমকি দেওয়া হয়। পরে আত্মীয় স্বজনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে আব্দুর রশিদ লাশ নিয়ে আলমডাঙ্গা থানায় উপস্থিত হন।


পরে আব্দুর রশিদ বাদী হয়ে জহুরুল ইসলাম ও পান্টু হুজুরসহ ৪ জনকে আসামী করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর পুলিশ গতকালই এরশাদপুরের ইছাহকের ছেলে জহুরুল ইসলাম, জহুরুলের মা জহুরা খাতুন ও সালাউদ্দীন পান্টু হুজুরকে গ্রেফতার করেছে।


ইতোপূর্বেও পান্টু হুজুরকে পুলিশ একাধিকবার গ্রেফতার করে। ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করা, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করা, ঈমান আকিদা নষ্ট হয় এমন বিষয় প্রচার প্রচারণা চালানোসহ একাধিক অভিযোগে বাংলাদেশ ঈমাম সমিতির আলমডাঙ্গা উপজেলা শাখার সভাপতি প্রভাষক আব্দুর রহমান ভন্ডপীর পান্টুর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সে সময় অনেক আলেম ওলামা থানায় গিয়ে ভন্ডপীর পান্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন যে, ২০০৬ সাল থেকে পান্টু নিজেকে আত্মার বিজ্ঞানী হিসেবে প্রচার করে আসছিল। সে নিজেকে বিশ্বসেরা আধ্যাত্মিক সাধক দাবী করে তাসাউফ বা তরিকত শিক্ষা দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষকে ঈমানহারা করার চক্রান্ত করেছে। আল্লাহকে নিজ চোখে দেখা, কথা বলা, আল্লাহকে দেখানো, মৃত্যু ব্যক্তির আত্মার সাথে স্বজনদের কথা বলানোর দাবী করে সে বির্তকিত হয়। শরিয়ত বিরোধী কথাবার্তা বলে আসছে। তার আখড়াকে মুরিদ যুবতীদের হারেম খানায় পরিণত করারও অভিযোগ উঠে। সে নিজেও নামাজ পড়েনা এবং তার মুরিদদেরকে নামাজ পড়তে নিষেধ করেন দাবি করা হয়। কোরআন সংশোধনের দাবীর মত কবিরা গুনাহের অপরাধ করে আসছিল বলেও অভিযোগ করা হয়।


সে সময় আলমডাঙ্গা থানার এস আই এমদাদ ও এস আই আফজাল সঙ্গীয় ফোর্সসহ এরশাদপুর গ্রমে পান্টু হুজুরের আখড়ায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে তাকে গ্রফতার করে। এ সময় ওই আখড়া থেকে বহু মহিলা ও যুবতী শিষ্যরা পালিয়ে যায়।


সে সময় গ্রামসূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন তার আখড়ায় শ-শ নারী- পুরুষ ছুটে আসেন। এদের বেশীর ভাগই নারী। পান্টু হুজুরের আখড়ায় এ সকল মহিলা ও যুবতীরা দিনের পর দিন অবস্থান করে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়টি অনেকেই বিরূপ দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখেন। এতে বহু সংসার ভেঙ্গে গেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গোবিন্দপুরের বারি শেখের ছেলে টিপু রাতে দীর্ঘদিন বাড়ি না থেকে আখড়ায় অবস্থান করে।

এতে তার সংসারে জ্বলছে অশান্তির আগুন। এরকম বহু যুবক স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। এরশাদপুর গ্রামের এক সময়ের শিষ্য খাদেমূল, হায়দার আলী, নজরুলসহ বহু যুবকের জীবনে পান্টু হুজুর অশান্তির আগুন জ্বেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরশাদপুর গ্রামের নুরুদ্দিনের ছেলে জাইদুল পান্টুর শিষ্য। তার চোখে সমস্যা ছিল। চোখের রোগের কারণে সে পান্টুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। আলমডাঙ্গা পোস্ট অফিসে তার নামে ১৩ হাজার টাকা ছিল।

বিষয়টি জানতে পেরে পান্টু হুজুর তার অপর শিষ্য বিনোদপুর গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে আব্বাসকে দিয়ে অবৈধভাবে প্রতারণা করে উত্তোলন করে। বিষয়টি জাইদুল জানতে পারলে এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে টাকা ফেরত পেতে চেষ্টা করে। আব্বাস কিংবা পান্টু হুজুর টাকা ফেরত না দিলে আলমডাঙ্গার পোস্ট মাষ্টার নিজের বেতন থেকে সেই টাকা পরিশোধ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কয়েকদিন পুর্বে ইবি থানার রাধানগর গ্রামের এক কৃষক থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন পান্টু হুজুরের বিরুদ্ধে যে, তার স্ত্রী পান্টু হুজুরের কাছে যাওয়া আসার একপর্যায়ে আর ফিরে যাচ্ছেনা। তার দাম্পত্য জীবনও শেষ হয়ে গেছে। তার স্ত্রী আর তার সাথে সংসার করতে চাচ্ছেনা। প্রতি মাসের ৫ তারিখে সে বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতীদের নিয়ে এসে গানের আসর বসায়। সে আসরে উপস্থিত অনেকেই দুই হাতে টাকা ছিটান। গতকাল সন্ধ্যায় পান্টু হুজুর গ্রেফতারের পর এধরণের নানা অভিযোগ নিয়ে বহু মানুষ এক দিকে যেমন সোচ্চার ছিলেন। তেমনই আনাগোনা ছিল পান্টু হুজুরের প্রভাবশালী দালালদের। জ্বিনের সাহায্যে পান্টু হুজুর ক্ষতি করতে পারেন এমন ভয়ে অনেকেই মুখ না খুললেও অনেকে জানিয়েছেন নানা কাহিনী। অনেকে দাবী করে বলেছেন, ন্যাড়া ফকিরদের মত পান্টু হুজুর বীর্ষ পতন রোধ করতে পারে। সেকারণে মহিলারা তার প্রতি অনেক আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এটাকে তিনি ঐশরিক ক্ষমতা বলে প্রচার করে ফায়দা লোটেন।


গত ২০০৭ সালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। সে সময়ে দীর্ঘদিন কারাভোগের পর সে ছাড়া পায়। ছাড়া পাওয়ার পর সে পুনরায় পীরত্বের ব্যবসায় ফিরে গিয়ে নতুন নতুন প্রতারণা শুরু করে। সে প্রচার করতে থাকে তার অলৌকিক ক্ষমতার মিথ্যা কাহিনী। তাকে কেউ গ্রেফতার করে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তাকে দেখে বিচারকের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে অনেকেই ভন্ডপীর দাবী করে উপযুক্ত শাস্তি দাবী করেছে।

২০০৭ সালে গ্রেফতারের পর তাকে আলমডাঙ্গা থানায় নিযে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তিনি সবগুলো কালেমা, আয়াতুল কুরছি বলতে পারেনি। ইসলামের মূলনীতিগুলো সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তৎকালীন কুমারী ইউপি চেয়ারম্যান মাও: আব্দুল কাদের বলেছেন, পান্টু ইসলাম ধর্মের ব্যাপক ক্ষতি করছে। সে ইসলাম সমর্থন করেনা এমন ইসলাম বিরোধী বিষয়গুলো ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এটা অনেক বড় অপরাধ।


গ্রামসুত্রে জানা গেছে, পান্টু হুজুর অনেক জায়গা জমি কিনেছে। একেবারে দরিদ্র পরিবারের ছেলে হলেও সে ভন্ড হুজুর সেজে আখড়া তৈরি করে মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে এখন কোটিপতি। হাটবোয়ালিয়া গ্রামের তার বোন জামাই জামাল হুজুরের মাধ্যমে হাটবোয়ালিয়া হাইস্কুল মার্কেটে সে একবারে ১২ লাখ টাকায় ৬ টি দোকান বরাদ্দ নিয়েছে। এছাড়া সে অন্য একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনেছে বলে এলাকারসুত্রে জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram