২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

বিস্মৃতপ্রায় মহান সাধক; মাওলানা আর্শাদুল আলম রাহ.

প্রতিনিধি :
ইমদাদুল হক
আপডেট :
আগস্ট ১৮, ২০২২
32
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
| ছবি : 

মাওলানা ইমদাদুল হক

জন্মঃ এলাকার সর্বজন মান্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, ফুরফুরাপীর সাহেবের ইজাযতপ্রাপ্ত খলীফা, বিশিষ্ঠ সমাজসেবক ও সংস্কারক, অসাধারণ বাগ্মী, নিভৃতচারী মহান সাধক মাওলানা আর্শাদুল আলম আনুমানিক ১৯০৮ সালে বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার অন্তর্গত তৎকালীন অখ্যাত, অপরিচিত, অজপাড়াগাঁ নওলামারী নামক এক ক্ষুদ্র গ্রামে অতিসাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শরীয়তুল্লাহ।

তিনি ছিলেন পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। পাঁচ সন্তানকে খুবই ছোট অবস্থায় রেখে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাওলানার বাবা-মা দুজনই একই দিনে ইন্তিকাল করেন। এরপর চাচাদের তত্ত্বাবধানে, বৃদ্ধা দাদির স্নেহছায়ায় লালিত-পালিত হতে থাকেন। তাঁর শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় কাটে গ্রামের আর দশটা ছেলের মতো গরু-মহিষের ক্ষুদে রাখাল হিসাবে।

শিক্ষা: মাওলানা যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন তখনকার দিনে এ এলাকা অজ্ঞতার অন্ধকারে এতটাই তমাসাচ্ছন্ন ছিল যে, গোটা অঞ্চলে সহীহ নযরানা কুরআন তিলাওয়াত করার মতোও একজন মানুষ ছিল না। পার্শ্ববর্তী গ্রাম রামদিয়ার ফজর সরদার নামক জনৈক ব্যক্তি কলকাতায় মুটের সরদার ছিলেন। ওখানে থাকতেই তিনি কুরআন তিলাওয়াত ও ইসলামি বিধি-বিধানের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। এক সময় তিনি কলকাতা ছেড়ে নিজ গ্রামে এসে বসবাস করতে থাকেন এবং এলাকার মানুষদের কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দিতে থাকেন। মাওলানার চাচা সম্পৰ্কীয় মুনশি আব্বাস আলী তার কাছে তালীম নেন ।

আর্শাদুল আলম তখন ১৫-১৬ বছরের বালক। দিনে মাঠে গরু চরান আর রাতে চাচার কাছে থাকেন ও কুরআনের তালীম নেন। আব্বাস মুনশি এই বালক ভাতিজার মাঝে সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে তাঁকে নিজ উস্তাদ ফজর সরদারের কাছে পাঠান। কিছুদিন যাওয়া-আসার পর ফজর সরদার এ বালকের সুমিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে এবং তীক্ষ্ণ ধী-শক্তির পরিচয় পেয়ে আব্বাস মুনশিকে ডেকে তাঁকে মাদরাসায় ভর্তি করানোর পরামর্শ দেন। বালক আশাদুল আলমও এত খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন।

কিন্তু পিতা-মাতাহীন এ এতীমকে কে মাদরাসায় পাঠাবে? উপরন্তু তখন মাওলানার পারিবারিক অবস্থা এমন ছিল যে, শুধু লেখাপড়ার জন্য কেউ-ই তাঁকে বাড়ির বাইরে বিদেশ-বিভূঁয়ে যেতে দিতে রাযি হবে না। তাই বাড়ির কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সে মোতাবেক আব্বাস মুনশি একরাতে আর্শাদুল আলম ও তাঁর বাল্যবন্ধু দরাপ মুনশিকে ইবাদত মুনশির বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন এবং সেদিনই রাতারাতি ওদের দুজনকে মুন্সিগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন— যেন কেউ এ কারসাজি টের না পায়। আর্শাদুল আলমের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তাঁর বৃদ্ধা দাদি নাতির শোকে কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায় হয়ে যান। এক সময় তিনি বুঝতে পারেন, এটা আব্বাস মুনশির কারসাজি। তাই মাঝেমাঝেই তিনি কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে এসে বলতেন, তুই আমার আর্শাদকে কোথায় রেখে এসেছিস? তাকে আমার কোলে ফিরিয়ে দে।

এভাবে পথের নানান চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে তাঁরা ফুরফুরা শরীফে উপস্থিত হন। সেখানে দরবার শরীফের মাদরাসায় কিছুকাল লেখাপড়া করার পর মাওলানা চলে আসেন খুলনায় মাওলানা হাতেম মোহাম্মাদ সাহেবের মাদরাসায়। অত্র প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়াকালে প্রচণ্ড মেধাশক্তি ও উন্নত চরিত্র বলে অতি অল্পদিনেই তিনি শিক্ষকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন, পান সর্ব্বোচ্চ স্নেহ-ভালোবাসা। তাই সেখানকার লেখাপড়া শেষ হলে স্বয়ং মাওলানা হাতেম মোহাম্মাদ (রাহ.) তাঁকে দিল্লির আজমীরী দরওয়াজায় অবস্থিত 'আল মাদরাসাতুর রশীদিয়া'তে ভর্তি করে দিয়ে আসেন।

আমাদের মাওলানা এই মাদরাসাতে যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর নিকট পড়াশোনা শেষ করে ৪৭/৪৮ সালের দিকে বাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর সহপাঠীদের অনেকেই জানিয়েছেন, তিনি প্রত্যেক শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। আমরা জানতে পেরেছি যে, বর্তমানে সেই স্থানে সে মাদরাসার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। মাওলানা তাঁর লেখাপড়ার কালে মাত্র দুয়েকবারের বেশি বাড়িতে আসেন নি

বিবাহ: হযরতের লেখাপড়া যখন শেষের দিকে সম্ভবত এক রমাযানের ছুটিতে তিনি বাড়ি আসেন। তখন তাঁর অসম্মতি সত্ত্বেও অভিভাবকবৃন্দ এক প্রকার জোর করেই বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার তাহেরহুদা গ্রামের রবকত মণ্ডলের জ্যেষ্ঠা কন্যা এলাচি নেসার সাথে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পরে অল্প কিছুদিন বাড়িতে অবস্থান করে শিক্ষা সমাপনের উদ্দেশ্যে পুনরায় তিনি দিল্লি চলে যান।

তাঁর ঔরসে সাতপুত্র ও তিনকন্যা জন্মগ্রহণ করে। পুত্রগুলো হল, ১. (নাম জানতে পারি নি), ২. বজলুর রহমান, ৩. হাবীবুর রহমান, ৪. মাহবুবুর রহমান, ৫, খলীলুর রহমান, ৬. আব্দুল মতীন ও ৭. ওয়ালিউর রহমান। প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ পুত্র তাঁর জীবদ্দশায়ই মারা যায়। কন্যাগুলো হল, ১. রহীমা খাতুন, ২. ফাতেমা খাতুন ও ৩. আকলিমা খাতুন।

কর্মজীবন: মাওলানা লেখাপড়া শেষ করে যখন গ্রামে আসেন এ অঞ্চলের চারিদিকে তখন আঁধারের ঘনঘটা। এ মুহূর্তে তাঁর আগমন নিশির তিমির বিনাশী সোনালী ঊষার সূর্যের ন্যায়। মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বানের মধ্য দিয়ে শুরু হল তাঁর কর্মজীবন। তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া অঞ্চল এবং বর্তমানের ঝিনাইদহ এলাকা ছিল তাঁর কর্মের ময়দান।

পারিবারিক পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না থেকে যোগ্য নায়েবে নবীর দায়িত্ব পালনে সদা ছুটে বেড়িয়েছেন ময়দানের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। পথহারা দিকভ্রান্ত মানুষকে শোনাতেন হেদায়াতের বাণী। তিনি ছিলেন অসাধারণ বাগী; ইলম, হেকমত ও আধ্যাত্মিকতার অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর বক্তৃতায়। তাঁর মুখনিসৃত বাণী যখন শ্রোতাদের কানে ধ্বণিত হত তারা হত আপ্লুত। “নিশ্চয় বয়ানে জাদু আছে' হাদীসের বাস্তবরূপ ছিল তাঁর বক্তৃতা। হাজার হাজার মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ ফেরদৌসি কাওসার পানে তৃপ্ত হত। কথা দীর্ঘ হলেও তারা ক্লান্ত-বিরক্ত হত না।

দিগন্তজোড়া মরু মাঝে পথহারা শত মুসাফির, মধ্যরাতের নিকষ কালো অন্ধকারে দিকভোলা অযুত পথিক তাঁর মাধ্যমে পেয়েছে পথের দিশা, আলোর সন্ধান। বছরের বেশিরভাগ সময়ই তাঁর বাইরে কাটত। এ কাজে তিনি এতটাই নিষ্ঠ ও নিমগ্ন ছিলেন যে, সংসারের আয়-রোজগারের বিষয়টাও ভাবতেন না। মাঠে কিছু জমি ছিল; ভক্ত-অনুরক্তরা সে জমি চাষ করে দিত। আর তাদের স্বতঃস্ফূর্ত হাদিয়া-তোহফায় চলত তাঁর সংসার ।

সুন্নাহর অনুসরণ: হযরত সুন্নাতে নববির অনুসরণ করতেন প্রতিটি পদক্ষেপে। আপন শরীর আপাদমস্তক যেমন থাকত সুন্নাতি লেবাসে সজ্জিত, তেমনি চব্বিশ ঘণ্টার জীবনে সুন্নাতে নববি ছিল তাঁর সকল কাজের মাপকাঠি। সে মাপকাঠিতে মেপেই সকল কাজ সম্পাদন করতেন। মাথায় সাধারণত পাগড়ি পরতেন। চলার সময় হাতে থাকত লাঠি। যারা তাঁকে দেখেছেন তারা সবাই বলেন, ‘সুন্নাতি লেবাসে এত সুন্দর আর কাউকে আমরা দেখি নি' ।

একবার তাঁর বৈঠকখানার নখ কাটছিল তাঁর কোনো এক সাগরিদ বামদিক থেকে। এ অবস্থা দৃষ্টে মাওলানার মাঝে সুন্নাতের মহাব্বত জোশ মেরে ওঠে, তাঁর কথায় ও চেহারায় ক্রোধের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাগরিদকে ধমক দিয়ে বলে দেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সকল ভালো কাজ ডানদিক থেকে শুরু করা পছন্দ করতেন।

লাজুকতা: আলিমগণ হচ্ছেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নায়েব, আম্বিয়াগণের ওয়ারিস। মাওলানা আর্শাদুল আলম ওয়ারিস সূত্রেই নববি লাজুকতার মেরাস পেয়েছিলেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কুমারী নারীর চেয়েও অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। তিনি প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতে দূরে চলে যেতেন। মাওলানাও মানবিক দুর্বলতার হাজত মেটাতেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, একান্ত নির্জনে, নিভৃতে। কেউই কখনো তাঁকে এসব হাজত পূরণরত অবস্থায় দেখতে পায় নি।

তিনি যখন মৃত্যু শয্যায়, মুমূর্ষু অবস্থা; স্ত্রী এলাচি নেসা হাতেপায়ে তেল মালিশ করছেন। পায়ে তেল মালিশের একপর্যায়ে লুঙ্গি একটু উচু করলে সে মৃত্যু কাতরতার ভেতরও তিনি নিষেধ করে দেন।

খিলাফত লাভ: মাওলানার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শুরু হয় ফুরফুরা শরীফের মাদরাসায়। এভাবেই তিনি ফুরফুরা সিলসিলার সাথে পরিচিত ও যুক্ত হন। লেখাপড়া শেষ করেও তিনি সেখানে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতে থাকেন এবং বায়আত হয়ে অতি অল্পদিনেই আধ্যাত্মিকতার উচ্চ মাকমে উপনীত হন। তৎকালীন ফুরফুরা দরবারের গদ্দিনশীন হযরত মাওলানা আব্দুল হাই সিদ্দীকি (রাহ.) তাঁকে খিলাফত দান করেন।

ফুরফুরা পীর সাহেব হুযুরের মেজো সাহেবজাদা হযরত আবু জা'ফর সিদ্দীকি (রাহ.) পূর্ববাংলায় তাঁর কোনো এক সফরে একদা আলমডাঙ্গার ছত্রপাড়া গ্রামে মাহফিল করেন। মাওলানা আর্শাদুল আলম সে মাহফিল-মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। মেজো হুযুর তাঁর বয়ানের এক পর্যায়ে শ্রোতাদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, আপনাদের এখানে ফজলি আম পাওয়া যায় কোথায়? উপস্থিত জনতা সমস্বরে জানান, রাজশাহিতে। হুযুর বলেন, যদি আপনাদের বাড়ির পাশে ফজলি আম পান তবে কি রাজশাহিতে যাবেন? শ্রোতারা বলেন, না, হুযুর! এবার তিনি আমাদের মাওলানা আর্শাদুল আলমকে দেখিয়ে বলেন, এই মাওলানা আর্শাদ-ই আপনাদের ফজলি আম। কেন আর কষ্ট করে সুদূর ফুরফুরায় যাবেন বায়আত হতে !

হারদির মাহফিলে মাওলানার বয়ান শ্রবণে বাংলাদেশে বসবাসরত বিশিষ্ট আলিমে দীন, আধ্যাত্মিকতার প্রাণপুরুষ, আওলাদে রাসূল হযরত মোস্তফা আল-মাদানি (রাহ.) খুবই মুগ্ধ হন। ফলে তিনি তাঁকে নিজের খলীফা হিসাবে ঘোষণা দেন এবং বায়আত করার ইজাযত প্রদান করেন। তবে আমাদের হযরত প্রচলিত অর্থে কোনো গদ্দিনশীন দরবারি পীর ছিলেন না। মানুষকে হেদায়াতের দিকে ডাকাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত এবং একাজেই তিনি সর্বদা ছুটে বেড়াতেন এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে। তাঁর ভক্ত-অনুরক্তের সংখ্যাও ছিল প্রচুর।

ইলম, ইবাদত ও নিমগ্নতা: ‘মাকামে আ'লা'য় পৌঁছানোর জন্য রাত্রি জাগরণ অপরিহার্য শর্ত। মাওলানা রাতে খুব কমই ঘুমাতেন। তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ও কিতাব মুতালাআয় জাগ্রত থাকতেন প্রায় সারাটি রাত। ‘কুতুব বীনি’ ছিল তাঁর কাছে নেশার মতো। কিতাবি যোগ্যতাও ছিল ঈর্ষণীয়। এবং তাঁর সংগ্রহেও ছিল অনেক কিতাব। ইন্তিকালের পর তাঁর সে সংগ্রহ সব বে-হাত হয়ে যায়।

একবার মাওলানা আবুল হাসান যশোরি (রাহ.) এর সাথে একটি মাসআলায় তাঁর মতানৈক্য হয়। হযরতের যুক্তি ও কিতাবের উদ্ধৃতিসহ দলীল শুনে যশোরি (রাহ.) চুপ হয়ে যান। যারা মুহাদ্দিস আবুল হাসান যশোরি (রাহ.)-কে চেনেন তাদের কাছে মাওলানা আর্শাদুল আলমের ইলমি মাহারত প্রমাণের জন্য এই একটি ঘটনাই যথেষ্ট। এমনিভাবে কখনো কোথাও কোনো ইলমি সমস্যা হলে তিনি কিতাবের পৃষ্ঠা নাম্বারসহ এমন অবলীলায় উদ্ধৃতি পেশ করতেন, যেন সামনেই কিতাব খোলা রয়েছে, অথবা এই মুহূর্তেই যেনবা মাসআলাটি দেখে কিতাব বন্ধ করেছেন।

তিনি ফজর নামাযের পর দীর্ঘ একঘণ্টা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তারপর ইশরাক পড়ে দিনের অন্যান্য কাজকর্ম শুরু করতেন। বিশেষ করে রমাযান মাসে তিলাওয়াত বহুগুণে বাড়িয়ে দিতেন।

সামাজিক অবদান: মাওলানা সুখেদুঃখে সর্বাবস্থায় বন্ধুর মতো মানুষের সাথে থাকতেন। বাইরের থেকে যখনই বাড়িতে ফিরতেন গোটা মহল্লার মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। সে আমলে এ অঞ্চল শুধু ধৰ্মীয় দিক দিয়েই জাহিলিয়াতে ছিল না, বরং জাগতিক শিক্ষাদীক্ষায়ও ছিল অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ অন্ধকার দূর করে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি মরহুম ইবাদত মুনশির সহায়তায় নিজ গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এক সময় মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং এ মর্মে মাটির একটি ঘরও নির্মিত হয়। তবে বন্যায় ঘরটি ধ্বসে যাওয়ায় সে প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়।

গ্রামের একমাত্র মসজিদটি ছিল মাটির দেয়াল ও চৌরি টিনসেড হযরতের একক প্রচেষ্টায় তা ইট-সিমেন্টের পাকা ছাদ বিশিষ্ট বিল্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়।

একবার তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ফলে সুযোগ পেয়ে যান জনগণের খেদমতের। তখন নওলামারী থেকে বাইরে যাওয়ার কোনো সড়ক পথ ছিল না। বর্ষাকালে গ্রামবাসী চলাচল করত ডিঙি-নৌকায় আর শুকনোর মৌসুমে মাঠের মধ্য দিয়ে মানুষ চলার ‘পাওটা’ যে রাস্তা চলে গেছে নওলামারী থেকে রায়সা পর্যন্ত সেই রাস্তার সাথে একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবেন।

নওলামারী-রায়সার মাঝখানে আছে মনিদুহার বিল। পশ্চিমের গ্রামগুলোর বর্ষার পানি এই বিল দিয়েই নেমে যায়। এখন রাস্তা করে এই বিলে বাঁধ দিয়ে দিলে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি আটকে এইসব গ্রামের মাঠঘাট ডুবে ফসল নষ্ট হবে। তাই এইসব গ্রামের লোকজন রাস্তা করার কঠিন বিরোধিতা করে। মাওলানা যেদিন গ্রামের লোকজন নিয়ে রাস্তা বাঁধতে বাঁধতে বিলের পাশে পৌঁছে যান ওইসব গ্রামের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে বাধা দিতে আসে। তিনিও গ্রামের লোকজন নিয়ে তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান। তিনি সামনে থেকে মুকাবালা করে তাদের হটিয়ে রাস্তার কাজ সমাপ্ত করেন।

গ্রামের সর্বসাধারণের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেবার জন্য তিনি নৈশ্য বিদ্যালয় চালু করেন। এক সময়ের অখ্যাত অপরিচিত নওলামারী গ্রামটি শুধু তাঁরই প্রভাব, প্রচেষ্টা, পরিচিতি ও খ্যাতিতে শিক্ষাদীক্ষা ও অর্থ-সম্পদসহ সকল দিকে অত্র অঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর পরিবারটি ‘মাওলানা বাড়ি নামে এলাকার সকল জনের সমীহের আসনে উন্নীত হয় ।

হযরতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল, কাবিল নগর ‘নসরুল উলূম আলিম মাদরাসা'। ফুরফুরার পীর সাহেব হুযুরকে দাওয়াত করে তাঁর মাধ্যমে এ মাদরাসার শুভ উদ্বোধন করান। মাওলানার কথায় এলাকাবাসী মাদরাসার জন্য অনেক জমি দান করেন এবং রেজিস্ট্রির সময়, তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও, মাদরাসার সকল জমির তারা তাঁর নামে দলীল করে দেন। বেশ কিছুকাল তিনি এই মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। এই সময়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন, মাওলানা আবু মুসা মোহাম্মাদ আলী (রাহ.), মাওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মাদ ওমর আলী (রাহ). এবং মাওলানা মোহাম্মদ রবিউল হক আনসারি।

মানুষের মাঝে হেদায়াতের বাণী ছড়িয়ে দেবার জন্য যেসব পদ্ধতি তিনি গ্রহণ করেন তার একটি হচ্ছে ওয়ায মাহফিল। এখন যেমন প্রতিটি গ্রামে/শহরে প্রতি বছর একাধিক মাহফিলের আয়োজন হয়ে থাকে তখন তা ছিল না। প্রথমে তিনি ফুরফুরার পীর সাহেবকে দাওয়াত করে ১৯৪৮ সালে নিজ বাড়িতে একটি মাহফিল করেন। তারপর প্রতি বছর তাঁর বাড়িতে মাহফিল হতে থাকে। সেই মাহফিলকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় ঈদের মতো উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। মহিলারা ঘরদোর, পোশাক-আশাক পরিষ্কার করত। প্রতি বাড়িতে দূরদূরান্তের আত্মীয়-স্বজন এসে ভরে যেত। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে মাহফিলে শরিক হত। ভক্ত-অনুরক্তরা চাল-ডাল, গরু-ছাগল নিয়ে এসে পাকশাক করে মাহফিলের দিন দুপুরেই খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে ফেলত।

মাহফিলের আলোচনা শুরু হত আসর পর থেকে। শ্রোতারা সকাল থেকেই আসা শুরু করত। অনেকেই আগের দিনই চলে আসত। মাহফিলে আলোচক হিসাবে আমন্ত্রিত হতেন দেশ বরেণ্য আলিমগণ । এই মাহফিলকে কেন্দ্র করে অনেক বরেণ্য আলিম এই অজপাড়াগাঁ নওলামারীতে এসেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় ‘মাওলানা বাড়ি’র এই মাহফিল আজও প্রতি বছর আয়োজিত হয়ে আসছে।

মাওলানা নিজেও ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। কাছেদূরে বিভিন্ন এলাকায় তিনি আমন্ত্রিত হতেন। আবে যমযম যে পান করেছে তার মুখে যেমন লোনা পানি রোচে না, তেমনি তাঁর বয়ান শোনার পর শ্রোতারা অন্য বিয়ানে আর মনোযোগ স্থাপন করতে পারত না।

বক্তারা সাধারণত আলোচনার শুরুতে দীর্ঘ ভূমিকা ও ভণিতা করে থাকেন; আর বিশেষ করে সে যুগের বক্তাদের আলোচনার সাধারণ বিষয় ছিল অনির্ভরযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয় কিচ্ছা-কাহিনী। এতে শ্রোতাদের হেদায়াতের তুলনায় মনোরঞ্জনের চিন্তা বেশি থাকে। কিন্তু মাওলানা আর্শাদুল আলমের আলোচনা ছিল কুরআন-হাদীস নির্ভর হেদায়াতি বয়ান । তিনি মানুষের মনোরঞ্জনের চিন্তা করতেন না। বরং উপস্থিত শ্রোতাদের প্রয়োজন বিবেচনা করে বয়ান করতেন। শুরুতে সংক্ষিপ্ত সুন্নাতি খুতবা পাঠ করে মূল আলোচনার ঢুকে পড়তেন। মহান আল্লাহ তাঁকে যে নুরানি চেহারা ও সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর দান করেছিলেন তাতে শ্রোতাবর্গ তাঁর নিরেট ইলমি আলোচনাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে শুনত।

ভালোবাসা, সম্মান ও সমীহ লাভ: তাঁর চেহারা-সুরত, আচরণ উচ্চারণ ও চাল-চলন সবকিছুই ছিল আকর্ষণীয়। উপরন্তু সবশ্রেণির মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াতেন; তিনি ছিলেন তাদের আস্থা ও বিশ্বস্ততার জায়গা। তাই আপামর জনতার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা তিনি পেয়েছিলেন। যোগ্যতা ও লাজুকতার অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর মাঝে। তাই সকল মানুষ তাঁকে সমীহ করে চলত। এ কারণে কোনো নিষেধ ও নির্দেশ এবং ক্ষমতার ব্যবহার ছাড়াই, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবেই, গ্রাম থেকে সকল প্রকার বে-শরা' কাজ উঠে গিয়েছিল।

হযরত তাঁর নিজ গ্রামকে একক প্রচেষ্টায় সম্পূর্ণ ইসলামি প্রভাব বলয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর ইন্তিকালের দীর্ঘ তিনযুগ পর আজো এই গ্রামে প্রকাশ্যে-মাইকে গান-বাজনা হয় না। যাত্রা থিয়েটারের আয়োজন হওয়া তো দূরের কথা, মাওলানার যুগে আশেপাশে বা দূরে কোথাও কেউ গান শুনতে গেলেও তাঁর সামনে পড়ার ভয়ে সদর রাস্তা দিয়ে যেত না; যেত মাঠ ভেঙে, বিল পেরিয়ে।

প্রথাগত কোনো শিরক-বিদআতের অস্তিত্ব এ গ্রামে আজো নেই। এসব নির্মূলে হযরতের পাশে ডানহাতের মতো লেগে থেকেছেন তাঁর বড় ভাইয়ের মেজো ছেলে মৌলবি আব্দুল ওয়াদুদ (রাহ.)। উল্লেখ্য, আব্দুল ওয়াদুদ (রাহ.)-সহ এলাকার যারাই ইলমে দীন শিক্ষা অর্জন করেছেন এবং বর্তমানে মাদরাসায় লেখাপড়া করছে, সবাই তাঁর রুহানি সন্তান, কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। এমন কি এ ঋণের কথা দীনমুখি কোনো সাধারণ মুসল্লিও অস্বীকার করতে পারে না।

হযরতের ব্যাপারে সকলের অন্তরেই শ্রদ্ধা মিশ্রিত এক প্রকার ভীতি কাজ করত। তাঁর উপস্থিতি দূর থেকে টের পেলেও কারো হাতে বিড়ি সিগারেট থাকলে ফেলে দিত, সতর খোলা থাকলে ঢেকে নিত, কাপড় উপরে থাকলে নামিয়ে দিত। কেউ হয়তো কাজ করতে বা পথ চলতে গানের কোনো কলি আওড়াচ্ছে। মাওলানার আগমন টের পেলেই বন্ধ করে দিত। কিন্তু এসব বন্ধ করতে তিনি কখনো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি, এমনকি মৌখিক আদেশ-নিষেধও করেন নি।

বরং কখনো কখনো এমন হত যে, কেউ হয়ত তাঁর উপস্থিতি বুঝতে না পেরে গান গেয়ে যাচ্ছেন; তবে তার গানে ভুল হচ্ছে। তিনি হেসে উঠে তার ভুল শব্দ ও পদ সংশোধন করে দিতেন। মাওলানা যেহেতু তাঁর শৈশব-কৈশোরে দীর্ঘদিন গ্রামের পরিবেশে থেকেছেন। তাই গ্রামীণ এসব পদ-পদাবলি তাঁর জানা ছিল। বাহ্যিকভাবে তিনি করে দিতেন গানের পদের সংশোধন, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাতে লজ্জায় এতটুকু হয়ে যেত। এতটুকুই তার সতর্ক ও সংশোধন হওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত।

এলাকার সব শ্রেণি ও পেশার, মত ও মতাদর্শের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে তাঁর উত্তম সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল। সকলেই তাঁকে সমীহ করতেন। তিনি কোনো আবেদন করলে তারা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। যেমন, রামদিয়ার ব্যারিস্টার বাদল রশীদ যখন কায়েতপাড়া হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা আর্শাদুল আলম (রাহ.)-কে দাওয়াত করে তাঁকে দিয়ে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করান। অথচ দুজন ছিলেন বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধে সম্পূর্ণ বিপরীত দু'মেরুর মানুষ।

মতানৈক্যের ক্ষেত্রে: আরব, ইরান ও ইয়ামানের দায়ি, মুবাল্লিগ ও বণিকদলের দাওয়াতে এ ভূখণ্ডের মানুষ দলেদলে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু তৎকালীন প্রেক্ষপটে শিক্ষক ও শিক্ষাপোকরণের স্বল্পতার কারণে এই বিপুল জনগোষ্ঠী ইসলামের মৌলিক শিক্ষাটুকুও অর্জন করতে পারে নি। তাদের ধর্মগুরু মোল্লা-মুনশিরাও ছিল অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত। এসব কারণে এবং পার্শ্ববর্তী ও পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাবে বিভিন্ন কুসংস্কার ও শিরক বিদআতকে তারা দীনের মূল অনুষঙ্গ মনে করে চর্চা করত। কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী ও অনুসারী কোনো আলেম যখন এ ধরনের কোনো অঞ্চলকে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসাবে গ্রহণ করে তখন এলাকাবাসীর সাথে মতাদর্শগত সংঘর্ষ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

মাওলানা আর্শাদুল আলম (রাহ.) এক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন। নিচ্ছিদ্র অজ্ঞতা ও কুসংস্কারপূর্ণ এলাকাকে নিজের কর্মের ময়দান হিসাবে গ্রহণ করেছেন। সেখানকার বিদআতি পীর-ফকীরদের বে শরা' কর্ম ও কর্মপন্থার সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন। অথচ কোনোদিন কারো সাথে তাঁর কোনো ধরনের ঠুকাঠুকি হয় নি। এর কারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব ও কর্মপদ্ধতি।

দাওয়াতি কথা ও কর্মের পূর্বে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে গঠন করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের সামনে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারত না। তিনিও কারো মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতেন না। মতানৈক্যপূর্ণ বিষয় আলোচনার সময় কঠোর ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেন না। ভিন্নমতের মানুষদের গীবত-শেকায়েত করতেন না। নিজের অনুসারীদেরকেও অন্যদের সমালোচনা করার অনুমতি দিতেন না। তাঁর আদব-শিষ্টাচার ও হৃদয়ের বিশালতার নিকট সব মত ও মতাদর্শের মানুষই আশ্রয় পেয়ে যেত। সবাই হয়ত মাওলানার সব মত গ্রহণ করত না, কিন্তু একবার সাক্ষাতের পর ভিন্নমতসহই তারা তাঁর আপনজন হয়ে যেত। বর্তমান বিবাদপূর্ণ সময়ে তাঁর কর্মপদ্ধতি চর্চা হওয়া খুবই জরুরি।

মৃত্যু: ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে মাওলানা স্বপ্ন দেখেন, মুনশি ইবাদত আলী (রাহ.) তাঁকে একটা নতুন সাদা কাপড় হাদিয়া দিচ্ছেন। পরবর্তী দিন ১৮ আগস্ট ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ২ ভাদ্র ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ বুধবার। হযরতের ভক্ত-অনুরক্তরা তাঁর জমিতে ধান কাটছে, বাড়ি এনে মাড়াই করছে, তিনি কাজ দেখাশোনা করছেন, তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। সারাদিন তাঁর ব্যস্ততায় কেটে গেছে।



কর্মময় দিনের শেষে নিস্তব্ধ রজনী। হযরত ওযু করে এসেছেন, ইশার নামায আদায় করবেন। হঠাৎ শরীরের মাঝে অসুস্থতা অনুভূত হল। তাড়াতাড়ি বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। ভাই ও সন্তানদের খবর পাঠালেন। শুরু হল মৃত্যু-যন্ত্রণা। একবার বলে উঠলেন, আজরাঈল, মৃত্যু-যন্ত্রণা এই, না কি আরো কঠিন? বড়ভাই খোরশেদ আলম এলে তিনি হাত বাড়াতে গেলেন। কিন্তু হাত অল্প একটু উঠেই নেমে গেল। সেই মুহূর্তেই মাটির কায়া ছেড়ে বের হয়ে গেল রূহ মোবারক। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন

মুষ্টিমেয় কয়েকটি মানুষের মুখে আনন্দের হাসি উপহার দিয়ে যে শিশুটি এই নশ্বর পৃথিবীতে এসেছিলেন, শতশত মানুষকে বেদনার সাগরে ভাসিয়ে তিনি আজ চলে গেলেন মাটির মায়া ত্যাগ করে অবিনশ্বর পরম প্রভুর দরবারে, রফীকে আলার একান্ত সান্নিধ্যে। মৃত্যুর সময় তিনি রেখে যান স্ত্রী, চারপুত্র, তিনকন্যা ও অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত, গুণগ্রাহী।

জানাযা হল পরবর্তী দিন। ইমামতি করলেন মরহুমের বড় জামাতা মাওলানা বশারত আলী (রাহ.)। তখন ভাদ্র মাস। এ গ্রামের সাথে যোগাযোগের স্থলপথগুলো পানির তলে। তবুও ডিঙি-নৌকায় করে অগণিত মানুষের জানাযায় উপস্থিতি তাঁর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। দাফন করা হয় পারিবারিক গোরস্থানে। যেখানটিতে কবর খনন করা হয় তার চারপাশ ছোঁয়া পানি। তবে আল্লাহর রহমতে কবরে একফোঁটা পানিও ওঠে নি।

সেদিন শতশত মানুষ তাঁর সালাতে জানাযায় প্রিয়জন হারানোর ব্যথা নিয়ে ভাঙা হৃদয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে দরবারে ইলাহিতে মাগফেরাত কামনা করে। আজো দূরদূরান্তের মানুষ এসে তাঁর কবর পাশে দুআ করে। তবে হযরতের কবরকে কেন্দ্র করে কোনো শিরক-বিদআত ও মাযারি ব্যবসা জমে ওঠে নি। তাই একমাত্র মাবুদ মহান আল্লাহর দরবারে জানাই লাখোকোটি শুকুর ও সুজুদ।

মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তার করা শুধু তিনটি আমলের ধারা বাকি থাকে- সাদাকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম, নেককার সন্তান যারা তার জন্য দুআ করে। মাওলানা আর্শাদুল আলম (রাহ.) এসব রেখে গেছেন। তিনি চলেন গেছেন। তবে তাঁর এসব আমলের সাওয়াব কবরে নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, মহান আল্লাহ তাঁর দীনের এ খাদেমকে আপন রহমতের চাদরে ঢেকে রেখেছেন।

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram