১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লকডাউন: দারিদ্র্য অথবা নব দারিদ্র্য

প্রতিনিধি :
সাম্প্রতিকী ডেক্স
আপডেট :
এপ্রিল ২৮, ২০২১
47
বার খবরটি পড়া হয়েছে
শেয়ার :
দারিদ্র্য অথবা নব দারিদ্র্য
দারিদ্র্য অথবা নব দারিদ্র্য | ছবি : দারিদ্র্য অথবা নব দারিদ্র্য

এখন সারা দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। এর আগের সপ্তাহেও লকডাউন ছিল, তবে অনেক মুখপাত্র এই শব্দটি পাল্টে বলেছেন বিধিনিষেধ। কার্যত ঐ সময় ট্রেন ও আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস ছাড়া অন্যান্য সব কাজই আগের মতো চলছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আক্রান্ত মানুষ ও মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি করে চলেছে, তার লাগাম  টেনে ধরতে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে এই অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু  দেখা যাচ্ছে এখন এই কঠোরতার মধ্যে বাস ও গণপরিবহন না চললেও মুভমেন্ট পাসের কল্যাণে ব্যক্তিগত বাহন বসে নেই; সেগুলো চলছে ভালোই, বিশেষ করে ঢাকার রাস্তায় তো এখন রীতিমতো গাড়িঘোড়ার জ্যাম শুরু হয়ে গেছে। মাঝখান  থেকে নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবন স্থির হয়ে গেছে; তারা দিন এনে দিন খায়, এই কর্মহীন সময়ে তাদের কোনো কাজ নেই, নেই কোনো বিকল্প আয়ের উৎস। এখন তাদের পেট চলবে কেমন করে?

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা মানব সভ্যতাকে নিয়ে যেভাবে পরিহাস করে চলেছে, তাতে বিশ্বের উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশ নির্বিশেষে সর্বত্র একটা অসহায় অবস্থা লক্ষ করা গেছে। বহু লোকজনের চাকরি চলে গেছে, যাদের চাকরি যায়নি, তাদের বেতন কমেছে, শ্রমজীবীরা শ্রম বিক্রি করতে না পেরে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে, পেটের দায়ে অনেকে পেশার পরিবর্তন করেছে, অনেকে শহর ছেড়েছে। পাঁচ বছরের দারিদ্র্য কমানোর অর্জন এক বছরের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিশ্বের সর্বত্র কভিড সংক্রমণের তাণ্ডব অনুভূত হচ্ছে, তবে আমাদের মতো পক্ষোদ্ভেদ অর্থনীতিতে এর ব্যাপকতা ও গভীরতা অনেক বেশি। অনেক দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি তো নেতিবাচক হয়ে গিয়েছিল। আমাদের অবশ্য সেটা হয়নি। কিন্তু  শ্রমজীবী ও স্বকর্মে নিয়োজিত স্বল্প পুঁজির প্রান্তিক মানুষদের ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। কিছু তথ্য-উপাত্ত দেখলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্কলন অনুযায়ী বিগত এক বছরে দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৯.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বিআইজিডি (BRAC Institute of Governance and Development) এবং পিপিআরসি (Power and Participation Research Centre) এ বিষয়ের ওপর পরিচালিত এক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে জানিয়েছে যে, দেশের ১৪.৭৫ শতাংশ অর্থাৎ ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্রদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কয়েক দিন আগে সিপিডি (Centre for Policy Dialogue) ও বিলস (Bangladesh Institute of Labour Studies) আরেকটি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায় যে, ৩ শতাংশ শ্রমজীবী কর্ম হারিয়েছে; পরিবহন, নির্মাণ ও অনানুষ্ঠানিক সেবা খাতে নিয়োজিত দশ লাখের বেশি দিনমজুর এদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যারা কোনোরকমে কর্মে বহাল রয়েছেন, তাদের মজুরি কমে গেছে ৩৭ শতাংশ। চলমান লকডাউন নিশ্চয়ই তাদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করে চলেছে। দানবটা এখানেই থেমে গেলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু কে জানে তার আর কত ঢেউ অবশিষ্ট আছে?

এই প্রেক্ষাপটে আর্থিক অবস্থার পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত ও পর্যাপ্ত। এ যাবৎ ২৩টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এটা আমাদের জিডিপির ৪.৪ শতাংশ। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের বেশ কিছু ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব সুবিধাভোগীরা প্রণোদনার অর্থ পেয়ে গেছেন। এর মধ্যে চরম দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষদের আয় সমর্থনের জন্য সব মিলে ৬টি প্যাকেজে (প্যাকেজ নম্বর ৮, ৯, ১০, ১১,২১ ও ২৩) মোট ৭ হাজার ৫২৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হয়। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব তহবিল থেকে বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে বেশ কিছু অর্থ বিতরণ করা হয়েছে ও হচ্ছে। মহানগর ও শহরাঞ্চলগুলোতে স্বল্পমূল্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রি করছে। এগুলো অবশই ভালো কাজ। তবে সরকারের মোট প্রণোদনার তুলনায় এবং চাহিদা বিবেচনায় এর আর্থিক মূল্যমান অকিঞ্চিৎকর, সিন্ধুতে বিন্দু; মাত্র ০.০৬ শতাংশ। অথচ আমাদের নিয়মিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে গড় বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশের বেশি।

করোনা সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা শুধু যে আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছেন, তাই না, তাদের নেওয়া ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ এ সময়ে পরিশোধযোগ্য কিস্তির টাকা শোধ না করলেও কেউ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন না। ফলে স্বাভাবিকতাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে খেলাপি ঋণের কলেবর কমতে দেখা যাচ্ছে। প্রকৃত অবস্থা অবশ্য বোঝা যাবে করোনা-উত্তরকালে। যা হোক, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের তরফ থেকে আবার প্রণোদনার দাবি আসতে শুরু করেছে। প্রাক-বাজেট সভাগুলোতে বিভিন্ন সেক্টরের কুশীলবরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে হয় প্রণোদনা চাচ্ছেন, না হয় চাচ্ছেন আরোপিত করভার কমাতে। করোনা তাদের হাতে তুলে দিয়েছে এক মোক্ষম হাতিয়ার। বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী ও মুনাফা সর্বাধিক করতে অভ্যস্ত ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এই সুযোগের যে সদ্ব্যবহার করবেন, তা বলাই বাহুল্য।  নৈতিকতার প্রশ্ন বাদ দিলে তাতে দোষেরও তেমন কিছু নেই, ব্যবসায়ীর মুনাফা বাড়লে তা পুনঃবিনিয়োগ হয়ে দেশে প্রত্যাশিত কর্মসৃজন হবে, বেকাররা চাকরি পাবে। এখন বেচারা সরকারের হয়েছে যত জ্বালা। একাধারে বিভিন্ন সেক্টরে পর্যাপ্ত প্রণোদনা দিতে হবে, কর ছাড় দিতে হবে, আবার পর্যাপ্ত বিনিয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের ক্লাব থেকে স্নাতক হিসেবে উত্তরণের সময় নির্ধারিত হওয়ায় এই বিনিয়োগের গুরুত্ব আরও বেশি। পর্যাপ্ত টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হলে তাতে সুপার ইনফ্লেশন হয়ে গরিবের আরও গরিব এবং ধনীর আরও ধনী হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।

এই অস্বাভাবিক অবস্থা বিবেচনা করে আগামী বাজেট প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও অর্থায়নের উৎস হতে হবে অসাধারণ ও উদ্ভাবনমূলক। সেখানে সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে; বেঁচে থাকার প্রচেষ্টাই হবে মোক্ষ। অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন যে, আগামী বাজেট হবে গরিব মানুষদের বাজেট। এটা অবশ্যই আশার কথা। কিন্তু এই অতিমারীর মধ্যে প্রণীত চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮.২ শতাংশ, এখন যা ৭.৪ শতাংশে সংশোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ বাজেটে প্রবৃদ্ধি বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল, জীবন, জীবিকা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা তেমনটা পায়নি। বেঁচে থাকার পরই তো উন্নতির চিন্তা! বাংলাদেশে শুধুমাত্র ১৯৭২ সালে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়, যেটা পরে আর কখনো হয়নি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ব্যাপক পুনর্বাসন কর্মযজ্ঞের জন্য ঐ ধরনের অস্বাভাবিক বাজেট প্রণয়নের প্রয়োজন ছিল যা পরবর্তী টেকসই ও স্থিতিশীল উন্নয়নের ভিত রচনা করেছিল। এবার ও আগামী বছরও এই অস্বাভাবিক সময়ের প্রয়োজনে জীবন, জীবিকা এবং সুরক্ষার স্থান রাখতে হবে সামনের সারিতে; প্রবৃদ্ধি ব্যাক বেঞ্চে। আর নতুন এই লক্ষ্যের মধ্যমণি করতে হবে নবসৃষ্ট দরিদ্র শ্রেণিকে। গতানুগতিক দরিদ্র ও অতি দরিদ্রদের জন্য কোনো না কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু রয়েছে; কিন্তু এদের জন্য কোনো কিছু নেই, অথচ এরা সম্ভবনাময় এবং প্রতিশ্রুতিশীল। কিছু দিন তাদের মুখের গ্রাসের ব্যবস্থা করা হলে এবং হারানো পুঁজি ফিরিয়ে দেওয়া হলে এরা আবার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে; প্রবৃদ্ধি প্রত্যাবর্তন করবে।

জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরোগ্যকারী ব্যবস্থার চেয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে টিকার স্থান হবে সবার ওপর। দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে এবং এর উৎসকে করতে হবে বহুমুখী। এই ভ্যাকসিন বছরাধিককাল ধরে প্রয়োজন হবে। এই জন্য একক বা যৌথ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে এটা উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারলে বেশি ভালো হবে। বাংলাদেশ ভ্যাকসিন উৎপাদন ও প্রয়োগে বিশেষ সুনামের অধিকারী। ভ্যাকসিন প্রয়োগে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা গেলে মানুষের মন থেকে শঙ্কা দূর হবে এবং অর্থনীতির দ্রুত পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে।

বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। দেশে এখন অনেক বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। কিন্তু উন্নত দেশের আদলে তাদের সামাজিক দায়িত্ব (Corporate Social Responsibility) পালন করতে বড় একটা দেখা যায় না; খেলাপি ঋণের ভারী বোঝা সত্ত্বেও ব্যাংকিং সেক্টরকে এ কাজে মাঝে মধ্যে এগিয়ে আসতে দেখি। কিন্তু অন্যত্র চিত্র ভিন্ন। করোনা মোকাবিলায় টুইটারের প্রধান নির্বাহী জ্যাক ডরসি দান করেছেন ১,০০০ মিলিয়ন ডলার, বিল গেট্স ও মেলেন্ডা গেটস করেছেন ২২৫ মিলিয়ন, উইপ্রো চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি করেছেন ১৩২ মিলিয়ন। এমনকি, সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত প্রতিদিন এক লাখ করে দিনমজুরকে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। দেশের এই দুর্যোগের সময় বড় বড় বিজনেস হাউজগুলো মানবতার সেবায় এগিয়ে এলে তা সরকারি প্রচেষ্টার সম্পূরক হিসেবে ভালো অবদান রাখতে পারে।

অভিযোগ রয়েছে যে, আমাদের ব্যবসায়ীরা শুধু গ্রহণ করতে জানেন; সংযমের মাস রমজান ও ঈদে-চাঁদে এই গ্রহণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়; প্রাকৃতিক কাজে ত্যাগ ছাড়া অন্য কোনো ত্যাগ তাদের ধাতে নেই। মানবিক বিপর্যয়ের এই সময়ে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করে তারা এই অভিযোগের অসত্যতা প্রমাণ করতে পারেন। কভিড মোকাবিলায় আমাদের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া অনেক ভালো কাজ করে আসছে; তারা ব্যবসায়ী হাউজগুলোকে এ কাজে আর্থিক সহায়তা দিতে উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচার কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারেন। প্রচারে এই ভালো কাজটির প্রসারণ ঘটার সম্ভবনা রয়েছে। কারণ, আমরা প্রচারপ্রিয়।

প্রতিটা চ্যালেঞ্জ কোনো না কোনো সুযোগ এনে দেয়। কভিড আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতায় মানবিক সমাজ গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে। এটার সদ্ব্যবহার করতে পারলে আমাদের অর্জন অনেক বড় হয়ে যাবে। 

লেখক খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক

সর্বশেষ খবর
menu-circlecross-circle linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram