এতদাঞ্চলে মরমী সুফিবাদের প্রবর্তক রায়হান উদ্দীন গাজীর তিরোধান দিবস উপলক্ষে আলমডাঙ্গার ফরিদপুরের গোলবাগানে ২ দিনব্যাপী সাধুসঙ্গের উদ্বোধন করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ সাধুসঙ্গের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
এ সময় তিনি বলেন, বাউল সম্প্রদায়কে পছন্দ করার অনেক কারণ আছে। তারা ব্যক্তিগত লোভলালসার উর্দ্ধে অবস্থান করেন। খুব সাধারণ তাদের জীবনযাপন। সমাজে অন্যায়-ফ্যাসাদ করেন না। মিথ্যা বলেন না, প্রতারণা করেন না। জীবনে শান্তি প্রত্যাশা করলে বাউলদের নিকট থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
আশরাফুল হক ঠান্ডু বিশ্বাসের সভাপতিত্বে ও আতিক বিশ্বাসের উপস্থাপনায় অনুষ্ঠিত ওই উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী মাস্টার, বেলগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম মন্টু, জামজামি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, বেলগাছী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মামুদুল হাসান চঞ্চল, সাংবাদিক প্রশান্ত বিশ্বাস ও সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম রোকন, ইউপি সদস্য বিপ্লব হোসেন, সংগীত শিল্পি রেজাউল ইসলাম ।
প্রসঙ্গত, কালের আবর্তে আজ মহান মরমী সুফিবাদের জনক রায়হান উদ্দীন গাজীর নাম সকলেই বিস্মৃত প্রায়। এতদাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ক্ষেত্রে তার অবদান সর্বাধিক বিবেচনা করা হয়। প্রতিয়মান হয় – এ অঞ্চলে তিনিই প্রথম মরমী সুফিবাদের প্রবর্তক। তবে রণগাজী বিশ্বাস নামেই তিনি এখন সমধিক পরিচিত। তার আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। এক সময় রহন গাজী নামেও পরিচিত ছিলেন। কালক্রমে আরও বিকৃত হয়ে তা রণগাজী নামে অবশিষ্টাংশে দাঁড়িয়েছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার ফরিদপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে তিনি মরমী সুফিবাদ প্রচার করতেন। এখনও কালের স্মারক হয়ে টিকে আছে তার মরমী সুফীবাদ প্রচারস্থল – গোলবাগান। তিনি ছিলেন খান জাহান আলীর শিষ্য ও সহযোদ্ধা। খান জাহান আলীর ইতিহাসের সাথে রায়হান উদ্দীন গাজীর ইতিহাস ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
১৪০০ সাল থেকে ১৪১১ সালের ভেতর দিল্লির সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ তার সেনাপতি খানজাহানকে দিনাজপুরের রাজা গনেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠান। যুদ্ধে রাজা গনেশ পরাজিত হয়ে ভাতুড়িয়াতে পালিয়ে যান। অঢেল সম্পদ হস্তগত করে খান জাহান আলী ১৪১৮ সালে যশোর বারোবাজারে পৌঁছেন। বারোবাজার যাওয়ার সময় খান জাহান আলী তার অধীনস্ত বিভিন্ন সৈন্যকে বিস্তর অর্থ সম্পদ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে রেখে যান ধর্ম প্রচারের জন্য। মুন্সি মেহেরুল্লাহ, চারুলিয়ার চার পীর, রায়হান উদ্দীন গাজী প্রমুখ তাদের অন্যতম। রায়হান উদ্দীন গাজী আলমডাঙ্গার ফরিদপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন।
তখন আলমডাঙ্গা জনপদের অস্তিত্ব ছিল না। ইসলামের কঠোর শরিয়তপন্থী খান জাহান আলীর সুযোগ্য শিষ্য রায়হান উদ্দীন গাজী ধর্ম সম্পর্কে উদাসিন এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মের আলো জ্বালাতে নিরলস পরিশ্রম করছিলেন। অথচ কঠোর পরিশ্রমেও মানুষের মাঝে সাড়া জাগাতে পারছিলেন না।
এই অঞ্চলের মানুষ গান-বাজনা নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করতেন। নামে মুসলান হলেও ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে তাদের সাক্ষাৎ ছিল না। তিনি অনুধাবন করছিলেন এ অঞ্চলের প্রকৃতিও আবহাওয়া মানুষকে ঘর ছাড়া উদাস বাউন্ডেলে জীবন যাপন করতে প্রলুব্ধ করে। এ সকল আত্মভোলা মানুষকে তিনি, শরিয়তের সুকঠিন অনুশাসনের নিগড়ে শত চেষ্টায়ও বাঁধতে পারেন নি। তিনি ইসলাম প্রচারের সুমহান স্বপ্ন বুকের গভীরে লালন করে সাধারণ মানুষের সাথে আরো বেশি একাত্ব হতে থাকলেন। যুদ্ধবিজয়ি গাজী সৈনিক হিসেবে বিপুল বিত্ত-বৈভব ছিল তাঁর। মানুষের বিপদ-আপদে অকাতরে অর্থ বিলোতেন। বুঝতে পারেন শরিয়তের কঠোর বাঁধনে এদের বাঁধা যাবেনা। ফলে সরে আসেন শরিয়তের কঠিন অনুশাসন থেকে। কৌশল পরিবর্তন করেন ধর্ম প্রচারের। গান বাজনার আয়োজন করে তিনি গ্রামবাসিকে সেখানে আমন্ত্রণ জানাতেন। সকল এলাকাবাসিকে এনে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা দিতেন। অল্প কয়েক বছরেই তিনি বেশ সফল হলেন। তাঁর নিকট থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা নিতে বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন।
জীবদ্দশায় তিনি ধর্মীয় চেতনায় আলোকিত করেন গোটা এলাকা। হয়ে ওঠেন জীবন্ত কিংবদন্তি। মধ্য যৌবনে তিনি ধর্ম প্রচারস্থলে গড়ে তোলেন মনোরম বাগান। যা বর্তমানে গোলবাগান নামে সমধিক খ্যাত। এখানে তিনি নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন তাল, তেতুল, বকুল, কুল গাছসহ নানাবিধ বৃক্ষ। তার নিজ হাতে রোপণকৃত কিছু তালগাছ ও তেতুল গাছ কালের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে প্রায় ৫শ’ বছরের অধিক যাবত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গোড়ামী আর অধর্মের নিকষ অন্ধকার থেকে মানুষকে মানবাতার আলোয় আলোকিত করেন। বাতলে দেন সঠিক পাথেয়। তিরোধানের পর কালক্রমে তাঁর প্রচারিত মরমী সুফিবাদের স্থলে স্থানীয় বাউল মতবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।