মাসুদ রানা, মেহেরপুর \ গ্রামের সহজ সরল কৃষক-কৃষাণীরা অক্লান্ত পরিশ্রমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ফসল উৎপাদন করলেও সফলতা অর্জন করতে পারে না অনেকে, শুধুমাত্র ভিত্তি বা প্রত্যয়িত বীজের অভাবে। তখন থেকেই তাদের চিন্তা ভালোমানের বীজ উৎপাদন করা। সরকারি পেঁয়াজ বীজের স্বল্পতা, বিশ্বস্ত বীজ বিক্রয় কেন্দ্রের কেনা বীজে বেশির ভাগ কৃষকই প্রতারিত হয়ে থাকেন। চাষীরা ১ বিঘা জমিতে নিজেই পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন শুরু করে।
উৎপাদিত বীজ থেকে স্থানীয় কৃষকের চাহিদা মিটিয়ে ব্যয় বাদে প্রয় ৩০ হাজার টাকা লাভ করছে। পেঁয়াজ বীজ চাষ করে অসামান্য সাফল্য দেখে যাচ্ছেন মুজিবনগর উপজেলার অনেকেই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পেঁয়াজ বীজ কিনতে আসেন ব্যবসায়ী ও চাষীরা। পেঁয়াজের বীজ দেখতে ছুটে আসেন স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। ‘সুখসাগর পেঁয়াজ’ চাষ করে গ্রামের প্রতিটি পরিবারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছিল। পরিবারের সদস্যদের মুখে ছিল হাসি, মনে ছিল আনন্দ। সে আশায় গত কয়েক বছর ধরে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার চাষিরা পেঁয়াজ চাষ করে আসছেন। করোনার সময় পেঁয়াজের দাম ছিলো অনেক বেশী। এই জন্য শীতাকলীন পেঁয়াজ চাষ করার সময় বেশী দাম দিয়ে বীজ ক্রয় করতে হয়েছে। শীতকালীন পেঁয়াজ আমরা বাজারে তুললে কম দামে দিতে হচ্ছে ।
এতে চাষ খরচ তো হচ্ছে না লোকসানের মুখে পড়ছেন তারা। তাই মেহেরপুরের চাষীরা নিজে বীজ তৈরীর উদ্যোগ গ্রহন করেছে।পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের জন্য পানি সেচ সুবিধা আলো-বাতাস ঠিকমতো থাকে এরকম উর্বর দো-আঁশ ও এঁটেল মাটি নির্বাচন করে কমপক্ষে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করে নিতে হবে। জমি তৈরির সময় পর্যাপ্ত পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ও শেষ চাষে বিঘাপ্রতি ইউরিয়া সার ৩৫ কেজি, টিএসপি সার ২৭ কেজি, এমওপি সার ২০ কেজি, জিপসাম সার ১ কেজি, বোরন সার ২ কেজি ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।এ জাতের পেঁয়াজের ফলন বিঘাপ্রতি ১০০ থেকে ১৭০ মণ হয়ে থাকে।
ভারত থেকে আনা উচ্চ ফলনশীল জাতের এ পেঁয়াজ চাষ করে ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে অনেকের। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ভরা মৌসুমে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমাদানিতে লোকসানের মুখে চাষিরা। এবারও দাম না পেয়ে হতাশ তারা। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজের আমদানি নির্ভরতা কমাতে টেকসই জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল এ পেঁয়াজের সংরক্ষণকাল বাড়ানো দরকার। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার বিশ্বনাথপুর, শিবপুর, আশরাফপুর, ট্যাংরামারীসহ বিভিন্ন গ্রামের মাঠজুড়ে শুধুই পেঁয়াজের ক্ষেত। কিন্তু ক্রেতা কম। অনেকেই জমি থেকে পেঁয়াজ তুলতে পারছেন না। শিবপুর গ্রামের জিয়াউল ইসলাম, হায়াত আলী, আশিক গাজী এবং বাবুল জানান, পেয়াজের বীজ এবছরে বেশী দামে কিনে দাম কম থাকায় জমি থেকে পেঁয়াজ তুলতে পারছেন না।
ফলে পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে আছেন তারা। তাই প্রতিটি চাষীরা পেয়াজের বীজ তৈরীর করছে নিজেরা। মেহেরপুর শিবপুর গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম লাভের আসায় এবার সাড়ে ২০ বিঘা জমিতে শীতকালীন পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। বেশী টাকা দরে ভারতীয় বীজ কিনে খরচ করেছে পেঁয়াজ চাষে। কিন্তু ভালো বীজ না হওয়ায় কয়েকবার লোকসানে পড়েছি। তাই আমি এবছরে পেয়াজের বীজ তৈরীর করার উদ্দ্যোগ গ্রহন করেছি। প্রতিবার 15 কাঠা জমিতে বীজ তৈরী করি। এবার ১ বিঘা জমিতে পেয়াজের বীজ তৈরীর করছি। পেয়াজ চাষে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুশিয়ে নেব। তার মত মেহেরপুরের শত কৃষকেরা নিজে বীজ তৈরীর উদ্যোগ গ্রহন করেছে।
সদর উপজেলা কাঠালপোতা গ্রামের পেয়াজ চাষী মিলন হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের চাষীরা প্রায় ৯০% মানুষ পেয়াজ চাষ করে। পেয়াজের দাম না পেলেও চাষ করে। বর্তমান বাজরের পরিস্থিতি এক বিঘা পেয়াজ চাষের জন্য বীজের দাম এবার অনেক বেশী দামে কিনতে হয়েছে। গত বার ৮০০ টাকা কেজী দরে বীজ কিনতে হয়েছে ভারতীয় বীজ। তাই এবছর আমরা নিজে পেয়াজের বীজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহন করেছি। মুজিবনগরের শিবপুর গ্রামের পেয়াজ চাষী হায়দার গাজী জানান, প্রতিবছর আমি পেয়াজ চাষ করি এবছরে লাভের আশা নেই। ভারত থেকে বীজের দাম বেশী টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে।
১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কেজি বীজ কিনে সেই বীজ ভালো ভাবে ফোটেনি। পুনরায় আবার বীজ কিনে পেয়াজ চাষ করতে হয়েছে। সব খরচ মিলে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে পেয়াজ চাষে। তাই আমরা এবছর নিজের জমিতে বীজ তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছি। পেয়াজ চাষী খোকন মিয়া জানান, প্রতিবছরই আমি পেয়াজ চাষ করি। সুখসাগর পেয়াজের বীজ বেশির ভাগই ভারত থেকে কিনে চাষ করি। এবছর তিন বার এক জমিতে বীজ ফুটাতে পারেনি। ১০ থেকে ১৩ হাজার টাকা কেজি দরে বীজ কিনতে হয়েছে। এসব বিষয় চিন্তা করে আমি নিজে আমার ১০ কাঠা জমিতে পেয়াজের বীজ তৈরীর করছি। আশা করা হচ্ছে এবার বীজ যদি ভালো করতে পারি তাহলে খরচটা একটু কমবে আমাদের পেয়াজ চাষে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, আমদানি নির্ভরতা কমাতে হলে অবশ্যই দেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
পাশাপাশি ভারতের এ জাতটি কাজে লাগিয়ে নতুন জাতের বীজ উদ্ভাবন করে পেঁয়াজের সংরক্ষণকাল বাড়াতে হবে। ভরা মৌসুমে যাতে পেঁয়াজ আমাদানি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার। মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক স্বপন কুমার খাঁ জানান, সারাদেশে এ জাতের পেঁয়াজের চাষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছে কৃষি বিভাগ। সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ সংরক্ষণের গবেষণা অব্যাহত আছে বলেও দাবি করেন তিনি। তবে পেয়াজ চাষ বাড়ছে। মেহেরপুর জেলার কৃষকরা নিজে বীজ তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে এবিষয়ে তিনি বলেন, কৃষকরা তাদের জমি বুঝে বীজ তৈরী করছে। তেমন কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে গত বছরের তুলনায় এবছরে বীজ উৎপাদন বেশী হবে। গতবছরে জেলায় পেঁয়াজের আবাদ হয়েছিলো ২ হাজার ১শ হেক্টর জমিতে, আর চলতি বছরে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৩শ ২০ হেক্টর জমিতে।